আয় সালমা, খেয়ে নিই।
সালমা অবাক হয়।
এত আয়োজন করেছ তোমার একলার জন্য?
তুই তো রয়েছিস। আমি তো হঠাৎ এলাম। নইলে তো তুমি একলা খেতে?
তা খেতাম। ওই যে বললাম, নিজের জন্য আজ সব আয়োজন পূর্ণ করে তুলতে ভালো লাগছে।
সাব্বির ভাই থাকলে বেশি ভালো লাগত।
তা অবশ্য নয়। সেটাও ভিন্ন জগৎ। দুয়ের মধ্যে তফাত অনেক।
দুজনেই খাওয়ায় মনোযোগী হয়। কোনটা রেখে কোনটা খাবে ভেবে পায় না সালমা।
তোমার কে কে আছে নাসিমা’পা?
বাবা-মা, ভাইবোন সব।
তারা খোঁজ-খবর নেয় না?
না। তোমার খারাপ লাগে না?
মাঝে মাঝে লাগে। তবে সেটা সাময়িক? খুব একটা বেদনাদায়ক নয়। আমার এক দাদু আছে। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি চলে আসার পর আমি তার অসুখের কারণ হই। ভাবতে মজা লাগে যে, নাসিমা একটি অসুখের নাম।
সালমাও হাসে। নাসিমা হাসতে হাসতে বলে, দাদু মরে গেলে কষ্ট পাব। তবে তেমন কিছু নয়। অনেক কষ্ট আছে, যা অনায়াসে খোলা যায়।
নাসিমা ভাত নেড়েচেড়ে উঠে পড়ে। হাত ধুতে বাথরুমে যায়। সালমা অবাক হলো। হঠাৎ এ পরিবর্তন কেন নাসিমা’পার? দাদুর জন্য মন খারাপ হয়েছে? অনায়াসে কষ্ট ভুলতে গিয়ে কষ্টের ফাদে বন্দি হয়নি তো আবার? কী জানি, কে জানে। কাউকে বোঝা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সালমা ভাবল। নাসিমা শুধু একটি অসুখের নাম নয়। কারো কারো নাসিমা নামে ভীষণ অ্যালার্জি। ও আরো গভীর কিছু ভাবতে চাইল। বাজে কথা, কষ্ট ভুলতে চাইলে অনায়াসে ভোলা যায় না। ওটা আরো গভীর করে গেঁথে যায় মনে।
নাসিমা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে ফিরে আসে।
তুমি তো কিছু খেলে না নাসিমা’পা?
আমি এমনই খাই।
তাহলে এত আয়োজন–
আয়োজনটা আনন্দের জন্য। তুই আবার খাওয়া ছেড়ে উঠে যাস না। যেন।
পাগল। কষ্ট ভুলতে গিয়ে আমি খাওয়া ছেড়ে দিই না কিন্তু নাসিমা’পা।
নাসিমা শব্দ করে হাসে। ফ্রিজের ওপরে রাখা কৌটো খুলে মসলা মুখে দেয়।
আমার জীবনটা এমনই, এই মৌরির গন্ধের মতো। বুঝলি সালমা, কেবলই সুগন্ধির পথে পথে আমাকে টেনে নিয়ে যায়।
কী জানি, অত বুঝি না। তবে সোজা পথ থেকে নেমে যেতে আমার ভালো লাগে।
কেউ কোনো কথা বলে না। নাসিমা চেঞ্জার ছেড়ে ডিভানের ওপর শুয়ে থাকে। লম্বা চুলের গোছা মেঝেতে গিয়ে ঠেকে। সালমা মাছের কাঁটা বেছে ভাত মুখে পপারে। বাড়িতে বাবা ওকে জোর করে খাবার জন্য বকে। আর এখন সালমার কেবলই খেতে ইচ্ছে করছে। মনে হয়, সারারাত ধরে খেলেও বুঝি তৃপ্ত হবে না। ক্লান্তি আসবে না।
বাইরে মেঘ মেঘ দুপুর ঝিমিয়ে আছে। গাছের পাতা থমথমে, পাখির ডাক নেই। ঝড় আসতে পারে। সালমা খেয়েদেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। বাড়িতে এখন কে কী করছে কে জানে। বাবা হয়তো ফেরেনি, তার জন্য সালমার কোনো চিন্তা নেই। ওই বাড়িতে সারাবছর উৎসব লেগে থাকলেও ওর কিছু এসে যায় না। সালমা এমনি নিস্পৃহ থাকতে পারে। নাসিমা চোখ বুজে আছে। ঘুমিয়েছে কি? চেঞ্জারে হিন্দি গান বাজছে। সালমার মনে হলো একদিন এমন এক দুপুরবেলা নাসিমা বলছিল যে মিউজিকে রং দেখা যায়। সালমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়। আজকের দিনটা তো সম্পূর্ণ নাসিমার নিজের। নিশ্চয়ই সে মুহূর্তগুলো নাসিমার সামনে অবলীলায় আসবে। সালমা ডিভানের পাশ ঘেঁষে মেঝের কার্পেটের ওপর বসে। নাসিমার চুলে হাত দেয়। মসৃণ তেলতেলে চুলের গোছা রেশমের মতো নরম।
কিছু বলবি নাকি সালমা?
নাসিমা চোখ না খুলেই কথা বলে।
আচ্ছা নাসিমা’পা আজকের দিনটা তো সম্পূর্ণ তোমার, না?
হুঁ। আজ তোমার আর কিছু করতে ইচ্ছে করছে না?
করছে।
কী?
নেশা।
বাহ চমৎকার। মন্দ হবে না।
মোটেই চমৎকার নয়। তার আগে তোকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
কখনো না।
সালমা একটু চেঁচিয়ে বলে!
তোকে যেতে হবে।
আমি কিছুতেই যাব না। তুমি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও আমি যাব। জোর করে থাকব।
বাপস একদম মিলিটারি মেজাজ।
নাসিমা হেসে ফেলে।
ঠিক আছে তুই থাক। কিন্তু সহ্য করতে পারবি তো?
খুব পারব।
নেশা কিন্তু সাংঘাতিক সালমা। জীবনের রং একদম বদলে দেয়।
সেই স্পর্শবোধে জীবনকে আমিও রাঙাতে চাই নাসিমা’পা।
নাসিমা চেঞ্জারটা বন্ধ করে দেয়। সালমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উপুড় হয়ে শোয়। মাদকদ্রব্যে নয়, শুধু নামেই যেন নাসিমার নেশা পেয়েছে।
জানিস ড্রাগসের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া বিভিন্নভাবে অনুভব করা যায়। আপার্সের অনুভূতি এক, ডাউনার্সের অনুভূতি অন্য। আর সাইকেডেলিক হলো একদম আলাদা। আপার্স স্নায়ুকে একদম উত্তেজিত করে তোলে। তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ঘুম আসে না। কথা বলতে ইচ্ছে করে। যাকে বলে বিরামহীন বকবকানি। চিন্তার গতি অসম্ভব বেড়ে যায়। বাস্তব ভিত্তিহীন কাজ এবং কথা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ডাউনার্স হচ্ছে এর উল্টো। এটা স্নায়ুকে অত্যন্ত দুর্বল, অন্য কথায় নিস্তেজ করে ফেলে। একটা ঢুলুঢুলু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আচ্ছন্ন করে রাখে। অথচ গভীর ঘুমও আসে না। না ঘুম, না জাগরণ অবস্থা আর কি। কোনোকিছু ভাবার ক্ষমতা থাকে না। সারাক্ষণ একটা বিষাদময় ঝিমুনির মধ্য দিয়ে সময় কেটে যায়। স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য হাত-পা ঝিমঝিম করে। মনে হয় শরীরে কোনো শক্তি নেই। হেরোইন, হাশিশ খেলে এমন হয়। সাইকেডেলিক হচ্ছে আপার্স এবং ডাউনার্সের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। উত্তেজনা ও অবসাদ দুটোই থাকে। দুটোর মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়। এমন এমন সব ঘটনা বা ভাবনা জন্ম নেয়, যা বাস্তবে একদম অসম্ভব। যেমন ধর পুরোপুরি এ অবস্থার মধ্যে মনে হবে চেঞ্জারে তুই যে মিউজিকটা শুনছিস তার একটা রং আছে, যা-ই দেখতে পাচ্ছিস। যেমন বাঁশির শব্দের রং নীল, ড্রামের শব্দের রং লাল, ভায়োলিনের রং ধূসর। এমনও দেখতে পারিস যে তোর সামনে ওই ফুলদানিটা হঠাৎ একটা বিরাট গণ্ডারের মুখ হয়ে গেল। তুই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলি। অথবা হাসতে আরম্ভ করলি কিংবা কান্না। যে-কোনো কিছু তোর মধ্যে হতে পারে। তার কোনো ঠিক নেই। তুই দেখবি, এই ঘটার আশপাশে কোনো দেয়াল নেই। চারদিকে শুধু আকাশ আর আকাশ। দেখবি রংধনু তোর সামনে একটা রঙিন সাকো হয়ে গেছে। তুই তার ওপর দিয়ে নির্বিবাদে পার হয়ে যাচ্ছিস। দেখবি তুই পানকৌড়ির মতো কেবল জলে অনবরত ড়ুবছিস আর উঠছিস। অবশ্য এ সবই আমার অভিজ্ঞতা সালমা। তোর অন্যরকম অনুভূতি হতে পারে। তবে জানিস, প্রায় সব ড্রাগসই তেতো।