বাইরে সাকিবের কথা শোনা যায়। বাবার কোনো ছাত্র এসেছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। একদিন একটি ছেলেকে সালমা অপমান করেছিল। সে আর কোনোদিন আসেনি। তার চাকরি হয়েছে কি না কে জানে। সালমা আলমারি খুলে শাড়ি বের করে। ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ আসে। এ গন্ধটা ওর ভালো লাগে। আলমারির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। বাইরে হঠাৎ রোদ কমে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, মেঘ করেছে। মন্দ না। যা গরম! এক পশলা বৃষ্টি এলে ভালোই লাগবে। হাওয়া বইছে জোরে। শাড়িটা পরে নেবার পর সালমার মনে হলো, কোথায় যাবে সেটাই এখনো ঠিক করা হয়নি। কোথায় যাওয়া যায়? এদিকে যা মেঘ করেছে যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে। হ্যাঁ ঠিক, টুক করে নাসিমা’পার ওখানে উঠে গেলে মন্দ হবে না। সাকিব একটু পরে বেরিয়ে যাবে মিষ্টির জোগাড় করতে। আর মা বাথরুমে ঢুকলেই হয়। কেউ টের পাবে না যে সালমা কোথায় গেল।
দুপুরের একটু আগে চুপচাপ দোতলায় উঠে আসে সালমা। ওকে দেখে হাসে নাসিমা।
কিরে কী খবর?
তোমার এখানে এলাম একটু শ্বাস ফেলতে।
বস।
নাসিমা ঘর গোছায়। জাপানি কায়দায় ফুল সাজিয়েছে। ক্রুশে বোনা টেবিলক্লথ, একদম নতুন ফ্রিজের ওপর কাচের নীল রঙের ফুলদানিতে তাজা গোলাপি গোলাপ শুধু। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ আসে। ডিভানে হালকা নীল ভেলভেটের চাদর। চারদিকে চমৎকার ছিমছাম ভাব।
কী ব্যাপার, কেউ আসবে নাকি নাসিমা’পা?
না তো!
যা চমৎকার ঘর সাজিয়েছ।
এ আমার নিজের জন্য সালমা। সবাই পরের জন্য সাজায়। নিজের কথা একটুও ভাবে না। আমি করি নিজের জন্য। ঘরটা সাজাবার পর এখন আমার নিজেকে বেশ পবিত্র লাগছে। দেখ না, একটু পর ধূপ জ্বালিয়ে দেব। ধূপের গন্ধ তোর ভালো লাগে না?
হ্যাঁ। ভীষণ।
তুই আজ আমার সঙ্গে থাকবি সালমা।
সাব্বির ভাই কই?
ও চিটাগাং গেছে।
সালমা মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এটাই ও চাচ্ছিল। কিন্তু এত সহজে কি নাসিমা’পার কাছে সবকিছু প্রকাশ করা যায়? সোফার ওপর কাত হয়ে বসে সালমা একটা বিদেশি পত্রিকায় চোখ বুলায়। নাসিমা তখনো ফুল নিয়ে ব্যস্ত। নানা কায়দায় ফুলদানি সাজাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনোটাই তার পছন্দ নয়। সে কারণেই মাঝে মাঝে তার গানের গুনগুনানি থেমে যায়। বিরক্তি প্রকাশ করে। আবার ফুলপাতা নিয়ে মেতে ওঠে। শিস বাজায়।
আজ নিজের হাতে বেশ কিছু রান্না করেছি সালমা। খেলে তুই অবাক হয়ে যাবি।
বেশ মজা। দিনটা আজ ভালোই কাটবে দেখছি। জানো নাসিমা’পা, তোমার এখানে এলে আমি অন্য জগতের স্বাদ পাই। নিজেকে হালকা মনে হয়। অথচ লোকে তোমাকে কত কথা বলে।
লোকের কথায় আমার কিছু এসে যায় না।
তুমি আজ ইউনিভার্সিটি যাওনি? ক্লাস ছিল না?
নাসিমা ফুলাদনিটা টিপয়ের ওপর রেখে সালমার পাশে এসে বসে।
কদিন থেকে একটা জিনিস নিয়ে আমি খুব ভাবছি সালমা। সাতদিন ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারিনি। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।
নাসিমার মুখটা চিন্তিত দেখায়।
কী ব্যাপার নাসিমা’পা?
ভাবছি ইউনিভার্সিটির চাকরিটা ছেড়ে দেব।
কেন? কেন?
ইদানীং মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের পড়ানোর যোগ্যতা আমার নেই। নিজেই কিছু জানি না, অন্যকে কী শেখাব।
কী যে বলো নাসিমা’পা। ইউনিভার্সিটিতে টিচার হিসেবে তোমার তো খুব নাম। সবাই তোমার লেকচার পছন্দ করে।
সে তুই বুঝবি না সালমা। ভীষণ গ্লানি আমাকে পেয়ে বসেছে। কাউকে নতুন কিছু শেখাতে পেরেছি বলে মনে হয় না। কদিন থেকে আমি মরমে মরে যাচ্ছি।
সালমা অবাক হয়ে নাসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাসিমা সোফার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। কী ভীষণ আত্মআবিষ্কার! বরাবর ব্রিলিয়ান্ট ক্যালিবারের মেয়ে ছিলেন। বিদেশ থেকে ডিগ্রি করেছেন। কিছু জানেন না বলে প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা নেই। সালমা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ওর উচ্ছাসে নাসিমাপা হয়তো আত্মঅহংকারে মেতে উঠবেন। না, সেটা হয়তো সম্ভব নয়। যে লোভ মোহ অতিক্রম করে সত্যকে চিনতে শেখে সে কী আবার নতুন করে ভুলে পথে পা বাড়ায়? কখনো না। জাহিদ চৌধুরীর মতো লোভী দুর্বলচিত্তের ব্যক্তিরাই মোহের গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়ায়।
নাসিমা চোখ বুজে বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়ি। গায়ের রঙের সঙ্গে প্রায় মিলে যায়। সালমা গা ঘেঁষে বসে আছে। সুন্দরের মাঝে নিজেকে পবিত্র করে তোলার আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত। একটু পরে ঘরে ধূপ জ্বলবে। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে আলো জ্বালবে। তারপর হয়তো গান শুনবে অথবা নিজে গিটার বাজাবে। হঠাৎ নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয় সালমার। মনে হয় অর্থহীন জীবনযাপন করছে ও। এ জীবনের বড় মূল্য নেই।
নাসিমা মাথা ঝাকিয়ে সোজা হয়ে বসে।
যাকগে, এ নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সাব্বির এলেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। কী বলিস?
চাকরি ছেড়ে দিয়ে কী করবে?
অন্য কিছু নিশ্চয় করব। এখনো ভেবে ঠিক করিনি।
নাসিমা শোবার ঘরে যায়। ধূপদানিতে ধূপ নিয়ে এসে জ্বালে। পর্দা টেনে জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়।
একটা আপন পৃথিবী তৈরি করিনি সালমা?
করেছ।
নাসিমা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে টেবিলে সাজায়। বুড়ি ঝিকে ইচ্ছে করে আজ ছুটি দিয়েছে। বেরি নাকি অনেকদিন মেয়ের বাড়ি যায়নি। অবশ্য অজুহাতের দরকার ছিল না। বুড়ি ছুটি না চাইলেও। নাসিমা আজ তাকে ছুটি দিত। সালমা আড়চোখে তাকায়। টেবিলে অনেক কিছু সাজিয়ে ফেলেছে নাসিমা’পা। এককোণে ফুলদানিও রেখেছে।