কাল বিকেলে বাসায় একটা পার্টি দেব ভাবছি।
ভালোই তো।
তুমি আর সাকিব দুজনে বাসায় থাকবে।
আমি থাকতে পারব না। আমার বাইরে কাজ আছে।
এমন কিছু জরুরি কাজ নিশ্চয় নয়?
হ্যাঁ, খুব জরুরি।
কী কাজ বলো?
সব কথা শুনতে চাও কেন?
লিমা!
তোমার জন্য আমার লজ্জা হয়। যা তোমার প্রাপ্য নয় সে সম্মান নিতে তোমার বিবেকে বাধে না?
সালমা দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। নিজের ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে। জাহিদ চৌধুরী হাঁ হয়ে থাকে। সালমা এমন আচরণ করবে ভাবতেই পারেনি। সাকিবও অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছে।
আমার এত বড় সাফল্যে মেয়েটা খুশিই হয়নি।
দিদিভাই এমনই। ওর কথায় তুমি কিছু ভেবো না বাবা।
তা নয় রে। ওকে ছাড়া আমি অন্য কিছুই ভাবতে পারি না। কী যে হবে ওর। ওর ওপর রাগ করা মানে নিজের ওপর রাগ করা।
জাহিদ চৌধুরী আবার নিজের কাজে ড়ুবে যায়। সালমার কথা ভেবে মন খারাপ করার সময় তার নেই। তাছাড়া ওর কথার অর্থ ধরার কোনো মানেই হয় না। ও যেসব কথা বলে তার সবটাই পাগলামি। অন্তত জাহিদ চৌধুরী তা মনে করে।
পরদিন বাড়িতে উৎসব। সারা সকাল সাকিব আর ঘর-দুয়ার গোছায়-সাজায়। সালমা চুপচাপ দেখে। মা ওকে কিছু বলেনি। ও নিজে থেকেও কিছু করেনি। সাকিব ওর দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। সালমা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝরঝরিয়ে পানি পড়ে। একে একে কাপড় খোলে ও। সাদা পিছল গায়ের ওপর দিয়ে জলের রেখা সরু হয়ে নামে। গুনগুনিয়ে গান গায়। কেন জানি ভীষণ ফুর্তি লাগে। ধেই ধেই করে নাচলেও তার প্রকাশ বুঝি ঠিক হবে না। কণ্ঠে গান উপচিয়ে আসে। একসময় গুনগুনানি বাদ দিয়ে গলা ছেড়ে দেয়। জলের নিচে দাঁড়িয়ে সালমা আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। কোথা থেকে যেন মুক্তি পেয়েছে ও। জলের স্পর্শে সে মুক্তি বাঁধনহারা হয়। গত রাতে বাবার মুখের ওপর একটা কথা ছুড়ে মেরেছে। জাহিদ চৌধুরী যদি বুদ্ধিমান হয় ওইটুকুতে তার সব বুঝে নেওয়া উচিত। না, বুঝলেও বুঝবে না। এখানেই জ্বালা। নিজের অন্তরে ছায়া দেখতে পায় না জাহিদ চৌধুরী। পেলে কি তার অন্তঃসারশূন্য আমিত্বকে বিপুল কলরোলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারত? জলের নিচে দাঁড়িয়ে সালমা আবার বিষণ্ণ হয়। জলের রেখা তেমনি সরু হয়ে নামে। বাবা সোরেন কেয়ারকে গার্ডের মতো হতে পারে না? লোকে তাকে পাগল বলত। তার ‘সোরেন’ নামটি পাগলের প্রতিশব্দ হয়েছিল অথচ ডেনমার্কের সেই পণ্ডিতের রচনা যখন ইংরেজিতে অনুবাদ হলো, দেখা গেল সেই নির্জনতাপ্রিয় আধপাগল লোকটি এক মৌলিক দর্শনের স্রষ্টা। সালমা চায় এমন একটি লোক যে আপন সাধনায় নিমগ্ন থেকে এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কারের জনক হয়ে যাবে। না চাইলেও লোক যার পায়ে ভক্তি, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় লুটিয়ে পড়বে। সালমার মাথাটা কেমন যেন করে ওঠে।
জাহিদ চৌধুরী তুমি এমনই মহৎ হয়ে যাও–এমনই মহৎ। তুমি চাকরিগত কোন্দল ছাড়। ঈর্ষাবিদ্বেষ ছাৰ্ডৰ ওপরে ওঠার জন্য সব নোংরা পথ আর বেছে নিয়ো না। তাহলেই আমি তোমার অনুগত বাধ্য হয়ে থাকব। তোমাকে আমি বার হিসেবে দেখতে চাই, যে আমার অন্তরে আলোর দিশা হয়ে জ্বলবে।
জলের নিচে কতক্ষণ ক-ত-ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সালমা জানে না। আনন্দের শিল্পিত মুহূর্তগুলো ধুয়ে মুছে নিঃশেষ। এখন জেগে থাকে সাদা বিষণ্ণতা। সাদা পিছল গায়ের মতো সে বিষণ্ণতা জলের রেখা হয়ে নামে। একটু বাতাসে জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে ও। শীত শীত লাগে। হাতের তালু কেমন চুপসে গেছে। চামড়া কুঁচকে আসছে। মাথা ভার হয়ে আসছে। সালমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে ও জলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে ট্যাপটা বন্ধ করে। ওই জল তার সাদা বিষণ্ণতা ধুয়ে নিতে পারে না। তোয়ালে চেপে ধরে গায়ের ওপর। ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে চুল থেকে। আয়নায় নিজের মুখটা দেখে চমকে ওঠে সালমা। একদম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওকে। শরীরের শীত শীত ভাব কমে না। সালমার মনে হয় উত্তাপ চাই। ভীষণ উত্তাপ। একদিন রকিব ওকে চমৎকার উত্তাপ দিয়েছিল। সেই নির্জন বাউরা দুপুরের কথা প্রায়ই মনে হয়। কেমন যেন লাগে। আম-কাঁঠালের ছায়ায় হরিয়ালের ঝাঁক দেখতে পায়। মনে হয় নাভির কাছ থেকে লাল পদ্মের ঘাণ উঠে আসছে। অন্তরে আর কোনো আসক্তি নেই। জাহিদ চৌধুরী মরে গেছে। রকিব হারিয়ে গেছে। জাগতিক সুখ-দুঃখ ঘুমপাড়ানিয়া দেশের সাঁতারু মেয়ে হয়ে গেছে। শুধু জলে তার প্রাণ। জলে তার আনন্দ।
আয়নার সামনে অনেকক্ষণ বসে থাকে সালমা। যত করে নিজেকে সাজায়। সাজাতে ভালো লাগে। জানালার পাল্লার ওপর দুটো বুলবুলি খেলা করে। সালমা পাউডারের পাফ গালে বুলোয়। জানালার ধারে আসে। ওর নির্জন পৃথিবীতে অনেক ঘাস গজিয়েছে। গাছগুলো কেমন নিজীব দেখাচ্ছে। আঙুরলতা শুকনো। যেন কোনো বসন্তের প্রতীক্ষায়। সালমা ঘুরেফিরে আবার আয়নার সামনে এসে বসে। নিজের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় ওর কোনো স্মৃতি নেই। ছোটবেলার কোনো পবিত্র স্মৃতি? না নেই। ভাবল থাকলে ভালো হতো। অন্তত মাঝে মাঝে সেইসব স্মৃতির মাঝে বিচরণ করে ও বিশুদ্ধ হয়ে যেত। আহ, স্মৃতি কত আকাক্ষিত। ছোটবেলার কোনো কথা ওর তেমন করে মনে পড়ে না। শুয়ে শুয়ে ওই স্মৃতি নিয়ে লোফালুফি করা যায়। অনেক খেলা জমে ওঠে। রুবা ভাবির চমৎকার স্মৃতি আছে। সালমার কাছে যখন সেসব গল্প করে তখন তন্ময় হয়ে যায়। রুবা ভাবির বারো বছর পর্যন্ত একটা মুক্ত জীবন ছিল। গ্রামীণ পরিবেশে অবাধ বিচরণ ছিল। বনবাদাড়, খালবিল, ধানক্ষেত, নদীর ধার প্রভৃতি নিয়ে। অনেক স্মৃতি রুবা ভাবির মনে। তরতরিয়ে গাছে উঠতে পারত। একবার জাম পাড়তে গিয়ে লাল পিঁপড়ের কবলে পড়েছিল, একবার ভরা বর্ষায় নৌকা করে পিকনিক করতে গিয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল, গ্রামের একটি ছেলে আত্মহত্যা করে পেয়ারা গাছে ঝুলেছিল–সব মনে আছে রুবা ভাবির। আরো কত অসংখ্য খুঁটিনাটি ব্যাপার আছে। শুনতে ভালোই লাগে। ওর এসব নেই। সালমার মনে হয় জীবনের বিশুদ্ধ ক্ষণ বড় পবিত্র। আর পবিত্র বলেই মানুষ তাকে ভুলতে পারে না। রুবা ভাবি এখনো নাকি স্বপ্ন দেখে সেই ছোটবেলার পরিবেশে। বর্তমান কাল, বর্তমান মানুষ, অথচ পরিবেশ সেই বিশ বছর আগের হারিয়ে যাওয়া স্থান। সেসব স্মৃতি রুবা ভাবির মনে কী সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করেছে! নইলে অবচেতন মনের সেই স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে বারবার। ভেসে আসত না।