কিছু না। তোমার যত পাগলামি।
রুবা ভাবি একটু যেন অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল। সালমাকে জড়িয়ে চুমু দিয়েছিল। খুশির উচ্ছ্বাসটা বেশি বলে সালমার রাগও হয়েছিল। কিন্তু তবু রুবা ভাবির ওপর রাগ করতে পারেনি ও। রাগ করে লাভ নেই। রুবা ভাবি এমনই।
সন্ধ্যার সময় বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা ওকে দিয়েছিল সাকিব।
জানিস দিদিভাই, বাবা না প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছে।
কী কারণে?
ওই যে দর্শনের ওপর লেখা বাবার বইটার জন্য।
তাহলে আর কি, খুশিতে লাফা।
তুই খুশি হোসনি?
খুশি হবার মতো কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
তুই যে কী দিদিভাই?
সালমা ওর সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। কাপড় ছাড়ে। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ চোখ-মুখে পানি দেয়। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সাকিবার একটুও বুদ্ধি নেই। এত তাড়াতাড়ি কথাগুলো না বললেই পারত। অবশ্য তাও নয়। ভালো মুড়ে থাকলেও ওই কথাগুলো সালমার গায়ে জ্বালা ধরাত। সহ্য হয় না ওর। বাবা তো গুটিপোকার মতো রেশমের সুতো দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করে এক স্বপ্নের মায়াপুরীতে বাস করে। নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে সচেতন নয় বলেই অযাচিত মূল্য গ্রহণ করতে পারে। এ পদ্ধতিতে যত সহজে নিজেকে ঠকানো যায় তেমনি তত সহজে অন্যকে ধাপ্পাও দিয়ে চলা যায়।
মাথাটা ধরেছে। সালমা বাতি বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কপালের পাশের শিরা দুটো দপদপ করে। কী যে হয়েছে ওর। বাবা সম্পর্কিত কোনো চিন্তা মনে এলে আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। বুনো রাগে অন্ধ হয়ে যায়। সালমা অনুভব করে অধিকারের যে সম্পর্কেই থাকুক, বাবার সঙ্গে ওর কোনো সত্যিকারের অন্তরঙ্গতা নেই। দুজনের মেজাজ ও চরিত্রে আকাশ-পাতাল তফাত। বাবা ওকে বলে ভাবপ্রবণ, মর্বিড। সালমার হাসি পায়। শব্দগুলোর সত্যিকার অর্থ বাবা জানে না। জানলে বলত না। বাবা নিজে কি তার অন্তর হাতড়ে কোনোদিন দেখেছে? বাবা অন্ধ। কিছু দেখতে পায় না। বাবা যত ইচ্ছে ওকে ভালোবাসুক তাতে ওর আপত্তি নেই। বাবার ভালোবাসায় ওর কোনো প্রয়োজন আছে কি না তার খোঁজেও বাবার দরকার নেই। অধিকারের জোরে অথবা ভালোবাসার জোরে কর্তৃত্ব খাটাতে এলেই যত আপত্তি সালমার। সালমার ক্ষেত্রে বাবার ভালোবাসার অর্থ ওর। নীতিজ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। সালমা বিড়বিড় করে, আমার স্বভাবের নিয়মের বাইরে আর কোনো অধিকার স্বীকার করি না। করি না–করি না। চেঁচিয়ে ওঠে ও।
কি হয়েছে লিমা? চিৎকার করছিস কেন?
মা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালে।
কীরে শরীর খারাপ?
হ্যাঁ। বমি লাগছে।
সালমা উঠে বাথরুমে যায়। বেসিনের ওপর বমি করে। নাড়িভুড়ি সব পাক খেয়ে উঠে আসতে চাইছে। পেট চেপে ধরে ও। টক টক গন্ধে মাথার দপদপানি আরো বেড়ে যায়।
তোর কী হয়েছে লিমা?
বাবা কাছে এসে মাথার ওপর হাত রাখে। পিঠে হাত বুলোয়। সালমা ট্যাপটা জোরে ছাড়ে। চোখ-মুখে পানি দেয়। চোখ দুটো জ্বালা করে। সালমা আবার শুয়ে পড়ে।
এক গ্লাস দুধ আর একটা নোভালজিন ট্যাবলেট পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নিস।
মা বাতি বন্ধ করে চলে যায়। একটু পরে আনুর মা দুধ আর ট্যাবলেট নিয়ে আসে।
আপামণি?
দাও।
সালমা ঢকঢক করে দুধ খায়।
বাবা কী করছে আনুর মা?
টেলিফোন করছেন। আজকে খালি টেলিফোন আসে।
বৈঠকখানায় কে কথা বলে?
কী জানি কত লোকজন এসেছে।
সালমা আবার চুপ করে যায়। হ্যাঁ, লোকজন তো আসবেই। সবাই বাবাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। ঘনঘন টেলিফোন করছে। একদল চিরকাল অন্যের স্তুতি গেয়ে সুখ পায়। নোভালজিনের দরুন মাথাব্যথা কমে যেতে থাকে। একটু একটু ভালো লাগে সালমার। পেছন দিকের বাগানের মাথার ওপর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ঠিক জানালার সোজাসুজি। কখনো মেঘ এসে ঢেকে ফেলে। মেঘ সরে গেলে উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায়। সালমা তাকিয়ে থাকে। টেলিফোনের সেই বন্ধুটির কথা মনে হয়। ও আর একদিনও টেলিফোন করেনি। সালমাও নাম্বারটা জানে না। সেই ভরাট কণ্ঠস্বর যখন কানে বাজে, মনটা শূন্য হয়ে যায়। অনুভূতি তেতো হয়ে থাকে। বড় জ্বালা। ঘুরেফিরে একটি বোবা বউয়ের কথা মনে হয়। কথা না জানলেও সুখ তৈরি করতে জানে। জংলি ছাপা শাড়ি পরে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। মধ্যবয়সী একটি লোক তার সান্নিধ্যে জীবনের সব ব্যর্থতার কথা ভুলে যায়। ব্যর্থতার গ্লানি ওদের হতাশ করে না। আম-কাঁঠালের নিরিবিলি ছায়া ওদের বিষণ্ণ করে না। আহ্, জীবনের কী বিচিত্র অনুভব। চাঁদটা আর দেখা যায় না। একটু করে ঘন কালো মেঘের আড়ালে চাপা পড়েছে। সালমার মনে হয়, অমন একটি কালো পাথর সালমাকেও চাপা দিয়ে রেখেছে। আজ রাতে ওই চাঁদ দেখা যাবে না।
দিদিভাই।
সাকিব এসে বিছানার ওপর বসে।
দিদিভাই ঘুমিয়েছিস?
না।
তবে চুপচাপ কেন?
বেশি কথা ভালো লাগছে না।
বাবা তোকে ডাকছে।
কেন?
জানি না।
সালমা আরো পাঁচ-সাত মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকে। সাকিব উসখুস করে।
যাবি না?
হ্যাঁ। যাচ্ছি চল।
সালমা উঠে বাবার ঘরে আসে। মা নেই। সম্ভবত বসার ঘরে অথবা রান্নাঘরে।
আমাকে ডেকেছ?
তোমার কি শরীর খারাপ?
না, এমনি মাথা ধরেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।
বসো।
ডেকেছ কেন?
বসো না।
সালমা চেয়ার টেনে বসে। কেমন অস্থির লাগছে। গা-টা গুলিয়ে উঠছে বারবার। বাবার ওই আত্মতৃপ্তির হাসি অসহ্য। সারা মুখে কী যেন চকচক করছে।