সালমার মনে হয় ও অনেকদূর পথ চলে এসেছে। অনেক রাস্তা পেছনে ফেলে ও তরতরিয়ে চলে এসেছে। একটুও কষ্ট হয়নি। বেদনা না, দুঃখ না, বিষণ্ণতা না, কেবল সুখের মতো ধানের শীষ সালমার বুকের মাঠে মাথা উঁচিয়ে আছে। আর কোথাও কিছু নেই। লোকালয় ছেড়ে চলে এসেছে বাইরে। সব পেছনে ফেলে। সব ছেড়েছুঁড়ে। তখনই মনে হয়, নগ্ন হয়ে গেছে ও। নগ্নতার লজ্জা পেয়ে বসে ওকে। আবিরের মতো রং ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় ও। তখন কিছু মনে থাকে না। ভেসে আসে পাখির মিষ্টি গান আর তখনই ঘুম পায় সালমার। ঘুম। ঘুম। হরিয়ালের ঝাঁকের মতো ঘুম এসে নামে দুচোখে।
শেষ বিকেলে রকিবের বুকে মুখ গুজে থাকা মাথাটা টেনে উঠিয়ে লাল হয়ে যায় সালমা। মিটমিটিয়ে হাসে রকিব। ওর ঘুম অনেক আগে ভেঙেছে। চুপচাপ শুয়ে ছিল। রকিবের মুখে হাসি দেখে সালমা মাথাটা বালিশে গুজে দেয় আবার।
তোর হাসি দেখলে গা জ্বলে।
রকিব হো হো করে হাসে।
উঃ, থামবি!
না, থামব না।
বেশ তাহলে আমি চলে যাই।
সালমা উঠে বসে। রকিব ওকে বুকের ওপর টেনে নেয়।
যেতে চাইলেই কি হয়?
সালমা কথা বলে না।
অ্যাই সালমা—
কী?
আবাল খেলা—
যা!
সালমা উঠে বাথরুমে যায়। হাত-মুখ ধুয়ে মাথা আঁচড়ে নেয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবার দেখতে পায় সেই বউটি। পরনে জংলি ছাপা শাড়ি। চোখে ঔৎসুক্য। বুকের মাঝে একটা লাল মোরগ। ওকে দেখে চট করে ঘরে ঢুকে যায়। সালমা যাবে কি যাবে না ভেবে পায় না।
দারোয়ান চা নিয়ে আসে।
তোমার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করা হলো না হামিদ?
কী আলাপ করবেন আপা, ও তো বোবা!
বোবা?
সালমার কণ্ঠে বিস্ময় উপচে পড়ে। অবাক হয়ে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, ওর বুকে সাগর আছে। সেই সাগরের তল নেই। অথচ সে ঠিকানা সালমার জানতে হবে। দারোয়ান দুটো চেয়ার বারান্দায় টেনে এনে দেয়। টেবিলে চায়ের ট্রে রাখে।
তুমি বোবা মেয়ে বিয়ে করলে কেন হামিদ?
মধ্যবয়সী দারোয়ানের মুখে হাসি। অপাঙ্গে চুলকানো সে হাসি নিয়ে নিজের ঘরের দিকে তাকায়।
বড় ভালো মেয়ে ও। ছোটবেলা থেকেই বাপ-মা কেউ নেই। চাচার কাছে ছিল। আমিও ওই বাড়িতে কাজ করতাম। চাচার বাড়িতে সুখ ছিল না ওর জন্য। ছিল কষ্ট। মুখ বুজে সব সইত। একদিন আমাকে ধরে অনেক কাঁদল। কিছু তো বলতে পারে না, কেবল কাঁদে। আমি বুঝলাম সবই। তারপর আমি ওকে বিয়ে করলাম। তখন ওর চাচা আমাকে এই চাকরিটা জোগাড় করে দিলো।
কথা যে বলতে পারে না, তোমার খারাপ লাগে না?
না। কথা দিয়ে কী হবে আপা। আমরা তো সুখেই আছি। এই আপনাদের মতো অনেকে আসে, তাদের সঙ্গে কথা বলি।
সালমা চুপচাপ শোনে। বউটিকে আবার দরজায় দেখা যায়। দারোয়ান উঠে চলে যায়। ইশারায় ওদের কী কথা হয়েছে কে বুঝবে। সালমারও যেতে ইচ্ছে করে। পারে না। কী বলবে ওখানে গিয়ে! দারোয়ানের কথার দরকার হয় না। ও চোখে চোখে কথা বলে।
ভালোবাসা বুঝি এমনি? ভালোবাসতে পারলে শুধু অনুভবে বুঝে নেওয়া যায়, শরীরের সব ইন্দ্রিয় কথার কাজ করে। আর কী। আর কী লাগে। ভালোবাসা না থাকলে দরকার হয় কথার। তখন চমক লাগাতে হয়। কথা তৈরি করে মন ভরাতে হয়। ইত্যাদি। ইত্যাদি। ঘুরেফিরে সেই কথাটা মনে হয় সালমার, কথা দিয়ে কী হবে আপা, আমরা তো সুখেই আছি।
দারোয়ান এক প্লেট আমের আচার নিয়ে আসে।
আমার বউ আপনার জন্য দিলো আপা—
ইস, তোমার বউ খুব কাজের তো–
সালমা আচার উঠিয়ে নেয়। মধ্যবয়সী লোকটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। জিভ দিয়ে আমের টুকরো চাটতে চাটতে সালমা দারোয়ানকে দেখে। লোকটা সিঁড়ির ওপর গিয়ে বসেছে। মধ্যবসয়ী লোকটার বুকের সাগর সুখের মুক্তোয় টইটম্বুর। ওরা বেশ ভালোই আছে। সালমার হৃদয় কাঁপে। কেন যে কে জানে! মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। সূর্য ডোবার পথে। বাড়ি ফিরতে হবে। রকিব কি আবার ঘুমিয়ে পড়ল? নাকি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে? ফিরতে হবে ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সালমা ওর যৌবনের কতকগুলো মুহূর্ত এখানে ফেলে যাচ্ছে। জীবনের এ লগ্নের এমনতর উপচার আর কোনোদিন দিতে হয়নি। কিন্তু কই, তার জন্য তো ওর কোনো খারাপ লাগছে না। কোথাও কোনো বেদনার রেখা নেই। ওই বোবা বউটির চোখের ভাষার উৎসুক হাসি সালমার যৌবনের রাজসাক্ষী। যমকুলির মিষ্টি গান সানাইয়ের সুরের মতো বেজেছে। সালমার বারবার মনে হয় ও ওর তেইশ বছরের যৌবনের সঙ্গে ওই মধ্যবয়সী লোকটার বয়স যোগ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই নির্জন ডাকবাংলাতে ও হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু সঙ্গী হিসেবে যা পেল তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই।
০৪. কথাটা সালমার কানে এলো সন্ধ্যায়
কথাটা সালমার কানে এলো সন্ধ্যায়। সারাদিন রুবা ভাবির বাসায় কাটিয়েছে ও। রুবা ভাবি কিছুতেই ছাড়েনি। কতকিছু বেঁধে খাওয়ায় ওকে। কোলের ছেলেটা বছর দেড়েকের। আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। রুবা ভাবির চোখে-মুখে চাপা খুশি। ও অবাক হয়। একটুও কি ক্লান্তি নেই রুবা ভাবির? কেমন করে পারে?
কথাটা শুনে তুই রেগে যাবি সালমা, তবু না বলে পারছি না–কথাগুলো বলার সময়ে রুবা ভাবিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল। সালমা একটু ঈর্ষা নিয়ে দেখছিল আর মুখটা গম্ভীর করে বলেছিল, শূন্যস্থান পূর্ণ করে পারলে না?
রুবা ভাবি হেসে মাথা নেড়েছিল। সালমা অনেকক্ষণ রাগে কথা বলতে পারিনি। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছিল। সারা দুপুর দুজন অনেক গল্প করেছিল। কত আবোল-তাবোল কথা। রুবা ভাবি বলেছিল, তোর গায়ে একটা আলগা সুগন্ধি আছে সালমা। তুই কী মাখিস?