যাহ্! বাজে কথা।
হ্যাঁ, সত্যি। লোকে বলে।
সালমার গাটা শিরশির করে ওঠে ওই পাখিটা যদি এখন ডেকে ওঠে তাহলে কে মরবে, ও, না রকিৰ আশপাশে তো আর কেউ নেই। সমস্ত পরিবেশ সালমার সামনে প্রথমে হলুদ তারপর খয়েরি হয়ে যায়। মৃত্যুর রং খয়েরি। পায়ের তলে পড়া শুকনো পাতার মতো মৃত্যুর পর মচমচিয়ে ভেঙে যায় শরীর। আর কিছু বাকি থাকে না। মিশে যায় মাটিতে। কেমন যেন লাগে সালমার। আবার সেই নসিয়া। মাথা ঘুরে ওঠে।
ওই পাখিটা যদি এখন ডাকে রকিব।
কী হবে, হয়তো আমি মরে যাব।
তুই কেন? আমি মরব।
কাউকে মরতে হবে না। ওই দেখ পাখিটা উড়ে চলে যাচ্ছে।
কোনদিকে যাবে?
কী জানি। চল, দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। দুজনে আবার হাঁটতে থাকে। কাঁঠাল-আমের ছায়া নরম মিনতিতে পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়। কোথাও সবুজ ঘাস। কোথাও লাল মাটি। দূরে চষা ক্ষেত। কোনো গাছ নেই। কেবল মাটির ঢেলা ওলটপালট হয়ে আছে। সালমার বুকটা কেমন করে। মাঠপারের অসীম শূন্যতা পেয়ে বসে। ডাকবাংলার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ে দারোয়ানের বউ নিজের ঘরের দরজার সামনে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে উৎসুক দৃষ্টি। মুখে বয়সের ছাপ জোয়ারের জলের মতো বিছিয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়ে নেই। হয়নি। ওদের দেখে বউটি আড়ালে চলে যায়। সালমার মনে হয় একবার গিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ করে আসা উচিত ছিল। এমন নিঃসঙ্গে কেমন করে ওর দিন কাটে? নাকি ও গ্রামের ছোট্ট মেয়ের মতো এখনো আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়ায়? প্রজাপতি ফড়িং জোনাকি ধরে? পুকুরের জলে সাঁতার কেটে পদ্ম তোলে? ওর অখণ্ড অবসর ও কেমন করে ভরিয়ে তোলে? সালমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
ওরা ফিরে আসার একটু পরেই দারোয়ান খাবার দিয়ে যায়। আলাদা স্বাদের রান্না। মৌরির মতো লাগে ওর। আলগা সুগন্ধি পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সমস্ত খাবারে। অনেক যত্নে তৈরি। বউটির নির্জন দ্বীপে সালমা এক নতুন অতিথি। ভাবতে গিয়ে পুলক অনুভব করে। রকিব কোথায় হারিয়ে যায়। অন্তর হাতড়ে রকিবকে খুঁজে পায় না সালমা। কেবল অনুভব করে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা কেউ যেন দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে জোয়ারের জলের রেখা।
তুই খাচ্ছিস না কেন সালমা?
খাচ্ছি তো।
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, ওকে খাওয়া বলে না।
বেশি দেখলে আমি কী করব।
সালমা উঠে পড়ে। খুব বেশি ও কোনোকালে খেতে পারে না।
জানিস সালমা, মনে হচ্ছে অনেকদিন পর একটা কিছু খাচ্ছি।
সত্যি? আমারও তাই মনে হয়েছে।
সালমা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। বালিশ টেনে নেয় কোলের ওপর। বাইরে আম-কাঁঠালের মাথার ওপর নির্জন দুপুর আঁকিয়ে বসেছে। জানালা দিয়ে দূরের আকাশে দৃষ্টি ফেললে দু-একটা ভুবন চিল উড়তে দেখা যায়। সালমার শরীর ঝিম ধরে আসে। অলস ঝিমুনিতে পেয়ে বসে। রকিব তখনো খেয়ে চলে।
সব শেষ না করে উঠবি না দেখছি?
আঃ, কথা বলিস না।
রকিব তৃপ্তির ভেঁকুর তোলে।
ঠিক আছে, ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে নিই।
সালমা টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। রকিব আড়চোখে ওকে দেখে। সালমা নির্বিকার। চোখ বুজে আছে। বাইরে শিরীষ গাছের মাথায় বসে একটা যমকুলি মিষ্টি স্বরে ডেকে যায়। টকটকে লাল ডানা আর চকচকে পালকে মোড়ানো সুন্দর পাখি। নির্জন দুপুরে মিষ্টি গানে তন্দ্রার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সালমা। মনে হয়, অনেককাল আগে কোথায় যেন ও একটা স্বচ্ছ জল টলটল সরোবর ফেলে এসেছে। সাদা-বুক মাছরাঙা সেই সরোবরে ডোবে আর ওঠে। সে পুলকের যেন শেষ নেই। সালমার মনে হয় সে-রকম একটা পুলক ওর ঘাড়ের কাছে থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আবার পায়ের তলা থেকে উঠে আসছে। আবার নামছে। আবার উঠছে। মনে হয় সাদা-বুক মাছরাঙা যেমন অনবরত ডোবে আর ওঠে ঠিক তেমনি একটা খেলা জমে উঠেছে। সালমার ভালোই লাগে। আরামে চোখ বোজে।
তবু স্বস্তি নেই। নাকের কাছে লাল পদ্মর ঘ্রাণ পায়। টকটকে লাল পদ্ম টলটলে জলে ভাসে। সালমার ড়ুবে যেতে ইচ্ছে করে সেই অতলে। আজ কেমন যেন লাগছে। একদম গা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছেগুলো আম-কাঁঠালের বনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে পাখি হয়ে চলে যেতে বাসনা হয়। অন্য কোথাও। অনেক দূরে। সেই রকম একটা নির্জন দ্বীপ বুকের ভেতর জেগে ওঠে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কেউ আর কোথাও নেই। কে যেন সলিমার সব অনুভূতি অবশ করে ফেলেছে। কই, কাউকে তো ডাকেনি ও! কে এলো চুপিসারে! ঘুম ঘুম লাগে। ঘুম আসে না। অথচ নিবেদনে মন চায়।
কানের কাছে অস্পষ্ট, ডাক শোনে সালমা। নির্জন দ্বীপে ও মাত্র একজন লোক খুঁজে পেয়েছে।
সালমা।
কথা বলিস না।
সালমা।
আঃ, কথা বলতে চাই না।
এখন কী করব সালমা?
সিঁড়ি দিয়ে তো নামছি।
তারপর?
সামনে জল টলটলে পুকুরে লাল পদ্ম ভাসে।
তারপর?
আমরা পদ্ম ছিঁড়তে জলে নামব।
আমরা পদ্ম বুকে নিয়ে জলে ভাসব।
আমরা পাতালপুরীতে চলে যাব। আবার সব এলোমেলো হয়ে যায় সালমার। সাদা মসৃণ মাখনের মতো ফিকে হলুদ গায়ের রঙের ওপর প্রজাপতি দেখতে পায়। প্রজাপতি ওড়ে সালমার শরীরে। সালমার মনে হয় অনেকদিন আগে ওর ঘরে রোজ প্রজাপতি আসত। এক-একদিন এক-একটা। কখনো সাদা দেয়ালে পেইন্টিংয়ের মতো বসে থাকত। পল গঁগার ছবি যেন। কখনো স্বচ্ছন্দে উড়ে বেড়াত। একটুও ভয় পেত না। সালমা কোনোদিন ওগুলো ধরার চেষ্টা করেনি। কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। আজ প্রজাপতি খুব কাছে। হাত বাড়ালেই ধরা যায়। ধরতে ইচ্ছে করে। ধরে বুকের আঁচায় ভরে রাখব নিশ্চিন্তে।