দিদিভাই?
সাকিব? দাঁড়া খুলছি।
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সালমার। সাকিব আর ও মাত্র এক বছরের ছোট-বড়, অথচ সাকিবকে এখনো গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করে। সালমার। ও নরমসরম। বাচ্চা পায়রার মতো। ভঙ্গিটা খুব সাবমিসিভ।
এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস দিদিভাই?
কই ঘুমোচ্ছি? শুয়ে শুয়ে তোর গিটারের বাজনা শুনেছি।
কেমন লাগল?
মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।
সত্যিই?
হ্যাঁ রে সত্যি। চমৎকার হাত তোর যত শুনি তত ভালো লাগে।
জানিস দিদিভাই, মিতালিও তাই বলে।
মিতালি?
ও সালমার বিস্ময়ে সাকিব একটু লজ্জা পায়। ঘাড় কঁকিয়ে বলে, মিতালি আমার বন্ধু। একসঙ্গে পড়ি।
ও!
সালমা আর কৌতূহল দেখায় না। তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢোকে।
মা তোর ওপর খুব ক্ষেপেছে দিদিভাই।
ক্ষেপুক। কিছু যায় আসে না।
তুই বেশি বেপরোয়া।
সালমা কথা না বলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। একটানা জল পড়ার শব্দ হয়।
সাকিব জানালা দিয়ে বাগান দেখে। দিদিভাইটা এমনি। কাউকে মানতে চায় না। আর সাকিব ইচ্ছে করলেও পারে না। ঘুরেফিরে আবার সেই একই জায়গায় এসে যায়।
অকারণে পথ হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ছাউনিতে ফেরে। দিদিভাই বড় শক্ত। ক্লান্ত হলেও গণ্ডিতে ফেরে না। নতুন ছাউনি খোঁজে। বাগানের গেট খুলে নাসিমা বেরিয়ে গেল। নাসিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি পড়ায়। চমৎকার লেকচার দেয়। সাকিব তন্ময় হয়ে শোনে। ও সাইকোলজির ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ার অনার্স ক্লাসে নাসিমার লেকচার ঝিরঝিরে নীল বরফপাতের মতো মনে হয় সাকিবের। যেমন উচ্চারণ তেমন বলার ভঙ্গি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ছিল নাসিমা। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। কেবল কাগুজে ডিগ্রি নয়, বিষয়ের ওপর চমৎকার দখল আছে নাসিমার। মনস্তত্ত্বের ওপর যখন পড়ায় তখন মনে হয় নাসিমা আপার সমগ্র জীবনটা বুঝি মনস্তত্ত্বের বিষয়। ছোটখাটো জিনিসকে চমৎকার বিশ্লেষণ করতে পারেন তিনি। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা সে বিশ্লেষণের ধার বাড়াতে পারে না। গভীর কিছু অভিজ্ঞতা সে জ্ঞানকে পূর্ণতা দেয়। অন্তত সাকিবের তাই মনে হয়। সমুচ্ছ্বসিত মন নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে সাকিব। আজ নাসিমার সঙ্গে ওর কোনো ক্লাস নেই। হিলতোলা জুতায় খুটখুট শব্দ তুলে নাসিমা যাচ্ছে। হাত দিয়ে ডেকে রিকশা থামাল। হাতে বড় ভ্যানিটি ব্যাগের সঙ্গে ভাঁজ করা ছোট গোলাপি ছাতা। কৃষ্ণচূড়ার লম্বা ছায়া ডিঙিয়ে রিকশাটা বেরিয়ে গেল। একটু পরে সাদা ড্যাটসান গাড়ি নিয়ে বাবা বেরোলো। মুখে পাইপ। পাইপ ছাড়া থাকতে পারে না বাবা। দর্শনের ওপর যখন বড় বড় প্রবন্ধ লেখে তখনো সারাক্ষণ মুখে পাইপ থাকে। সাকিব মনে মনে হাসল, বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাবার খুব নাম। চমৎকার বক্তৃতাও দেয়। ও মাঝে মাঝে অবাক হয়। এমন সাজিয়ে কেমন করে বলে বাবা!
বাথরুম থেকে দিদিভাইয়ের গান ভেসে আসছে। অবশ্য গান নয়, গুনগুনানি, হঠাৎ কখনো গলা ছেড়েও দিচ্ছে। সাকিব ভাবল, দিদিভাইটা বড় খেয়ালি। ওর একটা নিজস্ব গণ্ডি আছে। ওখানে ও আপনমনে সুখ-দুঃখ সাজায়। সাকিবের তেমন কোনো নিজস্ব কিছু নেই। সাকিব জলে সাঁতরানোর মতো সবকিছু কাটিয়ে যেতে পারে। কোথাও বাঁধে না। দিদিভাই পারে না। দিদিভাই ঘাসেও হোঁচট খায়। আর হোঁচট না খেয়ে চলতে গেলে ওর মনে হয় ও থেমে গেছে। চলতে পারছে না। সোজা পথে চলাটা কি চলা নাকি! সাকিব হাসে। দিদিভাইটা সত্যি পাগল। এজন্যেই ওকে এত ভালো লাগে। আসলে ও কোথাও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। আর পারছে না বলেই আশপাশের সবকিছুর ওপর ওর যত রাগ। যত বিতৃষ্ণা। এমনকি বাবা-মার নরম ভালোবাসাও সহ্য হয় না। বলে, বাবা-মা আমাকে করুণা করে। কেন করবে? জন্ম দিয়েছে বলেই আমার সব দায়দায়িত্ব তাদের নাকি? কে বলে আমাকে নিয়ে এত ভাবতে? তুই ওদের বলে দিস সাকিব, এসব আমার ভালো লাগে না।
সাকিব ঘরে ফিরে খাটের কাছে আসে। চাদরটা গোছায়। মেঝের ওপর থেকে বালিশ দুটো কুড়িয়ে এনে গুছিয়ে রাখে। বেড কভার দিয়ে ঢেকে দেয় বিছানাটা।
তারপর দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যালেন্ডার দেখে। রাশিয়ান ক্যালেন্ডার। প্রতিটি পৃষ্ঠায় বাচ্চার ছবি। চমৎকার স্বাস্থ্যবান বাচ্চা। দেখতে ভালো লাগে। হাসি-খুশিতে ফেটে পড়ছে যেন। একটা পৃষ্ঠায় এসে থমকে যায় সাকিব। বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ ঝলমল করছে। সাকিব মনে মনে ভাবে, এমন এক জোড়া চোখ আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে সালমা। সাদা তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল মাথার ওপর জড়ানো। পাড়-ছাড়া নীল শাড়ি পরেছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সাকিব আনমনা হয়ে যায়। অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকে সালমার দিকে।
কিরে, হাঁ করে কী দেখছিস?
তোকে দিদিভাই।
কেন?
দেখ, ঠিক এমন একজোড়া চোখ আমি খুঁজছি। তোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম। না, মিলছে না।
সালমা শব্দ করে হাসে। বারান্দার তারে ভিজে কাপড় মেলে দেয়। বাগানে জলিল কলাবতীর ঝোপ পরিষ্কার করছে। শুকিয়ে যাওয়া মরা পাতাগুলো টেনে টেনে ফেলে দিচেছ। বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছে ঝোপটাকে। সালমা পায়ে পায়ে বাগানে নেমে আসে। সামনে-পেছনে দুটো বাগান আছে বাড়িটার। এজন্যে বাবা বাড়িটা খুব পছন্দ করে।
ভাড়া বাড়িয়েছে। তবু ছাড়ে না। সামনে ফুলের বাগান, পেছনে ফলের। একটা আঙুর গাছও আছে। টক আঙুর। সালমা কলাবতীর ঝোপটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওই ঝোপটা পরিষ্কার করার কী অর্থ জলিলের মনে আছে? সেটা জানতে ইচ্ছে করে।