রকিব ওকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, কিরে এত দেরি কেন?
সালমা বলে, তোর মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে রকিব।
রকিব অবাক হয়, কেমন?
ঠিক তিমি মাছের পিঠের মতো।
সালমা শব্দ করে হাসে। রকিব ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সালমাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ও মাঝে মাঝে এমনি খেয়ালি হয়। তখন ওকে অসুস্থ দেখায়। অসুখী মনে হয়। উদাসীন সালমার কোনোকিছুতে ভ্রুক্ষেপ থাকে না। আজো ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে ওকে।
কোথায় যাব আমরা?
শহর থেকে অনেক দূরে।
চল।
স্কুটার ঠিক করা ছিল। দুজনে উঠে বসে। বাতাসে চুল ওড়ে সালমার। শাড়ির আঁচল রকিবের মুখে এসে লাগে। পেরিয়ে যায় শহরের কোলাহল। গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় কমে আসে। চারদিকে সবুজ। যতদূর চোখ যায় বিচ্ছিন্ন সবুজ অংশ নির্জন দ্বীপের মতো প্রতিভাত হয়। বদলে যায় সালমার মন। দখিনা বাতাসের মতো চমৎকার এক ভালো লাগা শরীরের ফোকর গলিয়ে সবখানে ঢুকে পড়ে। মাতিয়ে তোলে ওকে। সেই ধূসর বিষণ্ণতা সবুজ দৃশ্যাবলির সামনে তলিয়ে যায়। জেগে ওঠে নীলাভ সমুদ্র।
সালমা রকিবের হাত ধরে, আমার খুব ভালো লাগছে রকিব।
সত্যি?
হুঁ।
রকিব ওর পিঠের ওপর হাত দিয়ে কাছে টানে।
আমরা দুজন আর কখনো এমন করে বেরিয়ে পড়িনি।
না। রকিব আলতো চাপ দেয়।
আমরা অনেক আনন্দ মুহূর্ত নষ্ট করেছি।
হয়তো তাই।
স্কুটার এসে থামে ডাকবাংলার সামনে। বাগানের চারদিকে রক্তজবার সমারোহ। মাধবীলতার ঝড় উঠেছে গেটের দুপাশে। মৌসুমি ফুলে ছেয়ে আছে চারদিক। সালমা কী করবে ভেবে পায় না। দুজন বারান্দায় উঠে আসে। দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। রকিব ওর হাত। ধরে।
ভালো না জায়গাটা!
চমৎকার জায়গা। তুই কেমন করে খোঁজ পেলি?
এক বন্ধুর কাছে। সারাদিন আমরা এখানে থাকব সালমা।
ঠিক। জানিস রকিব, মনে মনে আমি এমন একটি জায়গাই খোঁজ করছিলাম। যেখানে পাথরের গা বেয়ে ঝরনা বয়ে যায়। হরিণ আসে দৌড়ে। শকুন্তলার সেই আশ্রমের মতো। এখানে তো সেসব কিছু নেই। কেবল আম-কাঁঠালের বন।
না থাক। আমি মনে মনে সব খুঁজে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি ধুলা-ওড়া রাস্তার দুপাশে ইউক্যালিপটাসের সারি। লম্বা লম্বা গাছের মাথায় বাবুই পাখির বাসার মতো ঝোপ। সেদিকে তাকালে মনে হয় আমি কী যেন ফিরে পেয়েছি। আমার আর কিছু চাই না।
তুই একটা বোকা মেয়ে সালমা। চল, ওই পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে আসি।
রকিব সালমার হাত ধরে হাঁটে। এমন নির্জন সঙ্গ ওর জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। সালমাকে এত কাছের মনে হয়নি কখনো। এত প্রাণখোলাও না। ওকে আজ অন্যরকম লাগছে। গজিয়ে ওঠা কচুপাতার মতো সতেজ আর পেলব। মোহনীয় বটে। আদতে সালমা একটা দুঃখী মেয়ে। সুখ ও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলে। আর অনবরত হারায় বলে কোথাও সালমার স্বস্তি নেই।
জল টলটল পুকুরের চেহারা। লালপদ্ম ভাসছে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নামে ওরা। নামে… নামে… নামে। বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি। নিচে জল। সালমা স্যান্ডেল খুলে পা ড়ুবিয়ে বসে। পানিতে ড়ুবে থাকা সিঁড়ির গায়ে শেওলার আস্তর পড়েছে। পায়ের তলা পিছল লাগে।
সঙ্গে কাপড় থাকলে গোসল করতাম।
কাপড় জোগাড় করা যাবে।
কোথা থেকে?
ওই দেখ না দারোয়ানের বাসা। ওর বউয়ের একটা শাড়ি নিয়ে আসব।
না বাবা, দরকার নেই। ওই তেল চিটচিটে ময়লা শাড়ি আমি পরতে পারব না।
তাহলে আর কি?
রকিব হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। তুই বোস। দারোয়ানকে কিছু খাবার ব্যবস্থা করতে বলি। রকিব লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে চলে যায়। সালমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। রকিব অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হয় ও বুঝি কোনো এক পাতালে নেমেছে। ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো শেষ হয় না। নিচের দিকে। নামতে নামতে সিঁড়ি যেখানে শেষ হয় সেখানে জল টলটল করে। একটু দূরে লাল পদ্ম। হাত বাড়িয়ে তুলে আনতে হয়। সালমার নসিয়ার মতো লাগে। চিৎকার করে ওঠে, রকিব আমি নামতে চাই না। উঠতে চাই। উঠতে চাই।
কিন্তু কেউ কোথাও নেই। সালমার ক্ষীণ কণ্ঠ বাতাসে এপাশ-ওপাশ দোলে। দারোয়ানের হাঁসগুলো জলে ভাসে। সালমা কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চায়। পারে না। সিঁড়ির পাশের দেয়ালের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে দেয়। সাদা হাঁসগুলো পরি হয়ে এসে সালমার হাত ধরে। সালমা যেন পাতালপুরীর রাজকন্যে। ওরা ওর চারদিকে পাখা ছড়িয়ে নাচছে।
কিরে, তোর মুখটা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?
রকিবকে সামনে পেয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সালমা।
রকিব, আমি নামতে চাই না।
ভয় কি, আমি তো আছি।
রকিব ওর গালে চুমু দেয়। কেউ টের পায় না। আম-কাঁঠালের ছায়ায় দুজনে ঘুরে বেড়ায়। এত কথা যে ওদের জমা ছিল তা ওরা জানত না। কখনো লুকোচুরি খেলে, কখনো অকারণ দৌড়াদৌড়ি করে, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চুমু খেয়ে সালমা আবার নিজেকে ফিরে পায়। ফিরে পায় সুখের লোমশ শরীর। ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে পাখিগুলো কিচকিচ করে। দূরের মাঠে হরিয়ালের ঝাঁক এসে বসে। শুকনো পাতা খয়েরি। পাকা পাতা হলুদ। সজীব পাতাগুলো সবুজ। নিজেকে অমন পাতার মতো মনে হয় সালমার। জীবনটা এমনি। সবুজ, হলুদ আর খয়েরি। এর বাইরে আর সব রং বুঝি বেমানান। সবুজ থেকে হলুদ হয়। হলুদ থেকে খয়েরি। হঠাৎ করে দৃষ্টি আটকে যায় একটা পাখির গায়ে।
ওটা কী পাখি দেখ তো রকিব? নীলের ওপর সাদা বড় বড় ফোঁটা। ঠোঁটটা কত বড় দেখ? আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।
পাখিটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না। তবে শুনেছি, ওটা নাকি যেখানে ডাকে সেখানে কেউ না কেউ মারা যায়।