আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে আসব। কাছেই তো।
সাকিব চটপটে উত্তর দেয়।
আসি সালমা আপা।
সালমা হেসে মাথা নাড়ে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের। বিদায় দেয়। ওরা চলে যেতে যেতে কী যেন কথা বলে আর হাসে। ওদের আচরণে ছেলেমানুষি চপলতা। সালমার বেশ লাগে। পাতলা ছিপছিপে মিতালি প্রায় সাকিবের সমান সমান লম্বা। মাথায় ববকাট চুল। শ্যাম্পু করা। কেমন মসৃণ ওর চুলের গোছা। মিতালি নির্জন দ্বীপের গানের পাখির মতো। ও দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। সালমা মনে মনে সাকিবের প্রশংসা করল। চমৎকার পছন্দ ওর। সঙ্গী হিসেবে এমন একজন পছন্দ করেছে, যে সামনে এসে দাঁড়ালে বেদনা কমে যায়। অহেতুক গান আসে মনে। মিতালি অবলীলায় সাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। হয়তো ওদের বিয়ে হবে। হয়তো হবে না। তাতে কী এসে যায়! যৌবনের গন্ধ কখনো ফুরায় না। সে গন্ধের বৃত্ত ছন্দ রচনা করে। অন্যত্র সুখ খোঁজে। পথে টেনে নিয়ে আসে। ভরিয়ে তোলে নতুন পেয়ালা। ভাবতে ভাবতে সালমার নেশা ধরে। বুক চেপে আসে। মনে হয়, ঠিক এ মুহূর্তে, এখন কাউকে চাই। নইলে ব্যর্থ হয়ে যায় লগ্নের খেলা। আঃ, কী কষ্ট! সালমা মনে মনে উচ্চারণ করে। অস্থির লাগে। চিৎকার করে কাউকে ডেকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। রকিবের কথা মনে হয় ওর। কখনো রকিবের দুচোখ জ্বলে ওঠে, কখনো সালমার হাত ধরে অনুনয় করে। সেই আর্তিটা আজ স্পষ্ট কানে বাজে। সালমার মনে হয় কে যেন দরজার গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। খুব মৃদু সে ধ্বনি। যেন কিসের মঙ্গলবার্তা বলে যাচ্ছে, ঘণ্টা হাতে লোকটা এগিয়ে আসছে। সালমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নিভে। যায় একশ পাওয়ারের বাল্ব। অন্ধকারে ফিসফিস করে সে বলে, আমি এসেছি।
নিবিড় অন্ধকারে মমতাময়ী হয়ে সালমাকে ঘিরে রাখে। এক টুকরো আলো শুধু একটা মুখের ওপর ঝুলে আছে। হাতে তার ঘণ্টা। একটানা বেজে চলে।
সালমা হাত বাড়ায়। সমুদ্রের ওপর থেকে স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে যায়। অদ্ভুত ঠান্ডা। কোথাও আলো নেই। এখন অন্ধকারই আপন। আর কিছু চাই না। আর কিছু না।
সালমা উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। বাইরে জানালার ধারে ওর নির্জন দ্বীপ। সে দ্বীপ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। অজস্র অসংখ্য ফুলে ছেয়ে যায়। এত ফুল একসঙ্গে সালমা কোনোদিন দেখেনি। এত বিচিত্র রঙের সমাবেশ আর কখনো চোখে পড়েনি। সালমার মনে হয় ফুল ছাড়া আর কিছু সত্য নয়। ফুল আনন্দ। ফুল বেদনা। হাসি-কান্না সব। আস্তে আস্তে কোমল প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। কোথাও বেদনা নেই। জ্বালা নেই। ছড়ানো ফুলের মতো অনুভূতির সব রং মিলেমিশে এক হয়ে আছে। ভিন্ন রঙে তার কোনো প্রতিভাস নেই।
সালমা বালিশে মুখ গুঁজে দেয়।
সকালে ছিমছাম করে নিজেকে সাজায় সালমা। আজ মনটা বেশ আছে। ভয়ানক হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে। কপালে লাল টিপ দিতে দিতে মনে হয় লাল টিপ রকিবের খুব পছন্দ। আজ ওরা দুজনে অনেক দূরে যাবে। রকিব কিছু বলেনি। শুধু বলেছে যাবার জন্য। সালমার একঘেয়ে লাগছে। কোথাও যেতে পারলে ভালো লাগত। দশটায় রকিব বলাকার সামনে আসবে। ওখান থেকে দুজনে যাবে। সালমা গান গাইতে গাইতে চুল বাঁধে। মা এসে সামনে দাঁড়ায়।
বেরোচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ।
তোর সঙ্গে কথা ছিল।
বলো।
সালমা ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে।
বলছিলাম কী জহিরকে তোর কেমন লাগে?
কেন?
না মানে তোর বাবার খুব পছন্দ কি না।
যা বলবে খোলাখুলি বল–
জহিরকে তোর জন্য পছন্দ করেছে তোর বাবা। এখন তোর মতামত পেলে আমরা কাজে এগোতে পারি। ছেলেটি কিন্তু খুব ভালো। তোর বাবার ভক্ত।
তাহলেই হয়েছে।
কী?
ওই যে ঘুরেফিরে এক কথা। ভালোর সংজ্ঞা মানে অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরী।
কী বলছিস লিমা?
ঠিকই বলেছি। তোমরা অন্ধ, তাই ভালো-মন্দ বুঝতে পার না। বাবার মতো ছেলে আমার কোনোদিনই পছন্দ না।
নিজের বাবা সম্পর্কে–
তুমি আমাকে বেশি কিছু বলার সুযোগ দিয়ো না মা।
তোর মতটা বল?
মত নেই।
ও।
মা কেমন অপমানিত বোধ করে। মুখটা লাল হয়ে যায়। তবু কিছু বলতে পারে না। সালমাকে বড় ভয়। মাঝে মাঝে মা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অবাক লাগে। সালমাকে চেনে বলে মনে পড়ে না। কোনোদিন ওকে দেখেছে বলেও মনে হয় না। সালমা মার মুখের দিকে তাকায়। মা উঠে যেতেই সালমা বলে, শোনো মা, আর কোনোদিন আমাকে এসব কথা বলতে এসো না।
মা আর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সেই বেদনাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়েও সালমার মায়া হয় না। সম্পর্কের অধিকারের সুতোটা বড় জঘন্য। ওটা গলায় পরাতে চাইলেই ও নির্মম হয়ে ওঠে। মা বেরিয়ে যাবার পরও সালমা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। জাহিদ চৌধুরী নামটা ভাবলেই সালমার মনে হয় একটি ফাঁকির পাহাড়। লোভের রক্তপিণ্ড। খ্যাতির পঙ্কে ড়ুবে যাওয়ার বাসনা-পোকা। এছাড়া জাহিদ চৌধুরী আর কী? মৌলিক কিছু করার ক্ষমতা তো নেই তার। কেবল চর্বিত চর্বণের বাহাদুরি দেখিয়ে দুহাতে হাততালি লুটছে। আসলে নিজের সম্পর্কে যার কোনো বিবেচনা নেই, অহেতুক বাহাদুরি নিতে যার ঘৃণা নেই, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক স্বীকার করতে সালমার ঘৃণা। সালমার মাথাটা ঝাঁকিয়ে ওঠে। বেড়াতে যাবার আনন্দটা বুঝি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার সেই ধূসর বিষণ্ণতা পেয়ে বসে সালমাকে। খরগোশের লোমশ শরীরের মতো ধূসর বিষণ্ণতা বাড়তে থাকে। যন্ত্রচালিতের মতো ও উঠে চুল বাঁধে। শাড়ি পরে। স্যান্ডেলে পা ঢোকায়। এবং একসময় ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চারদিকের লোকজন গাড়ি, রিকশা–সবকিছুর মধ্যে ধূসর বিষণতা অনবরত জমতে থাকে। সালমার আর কিছু ভালো লাগে না।