কত জায়গায় চেষ্টা করেছেন?
অনেক। কোথাও শুনতে পাই বাঁজখাই কণ্ঠ, কোথাও চাকরের গলা, কোথাও বাচ্চা ছেলে। বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেব ভাবছিলাম। এমন সময় আপনাকে পেলাম।
বেশ মজা।
শব্দ করে হাসে সালমা। ওর মনে হয় ওর ভেতরকার সেই বিষণ্ণ ভাবটা অনবরত বেরিয়ে যাচ্ছে। বুকটা ঝরঝরে লাগছে।
তোমার খারাপ লাগছে না রে সালমা?
না। তোমার?
সালমা দুঃসাহসী হয়ে নিজেও তুমি বলে। দেখা যাক না খেলাটা কতটুকু জমে ওঠে।
অদৃশ্য লোকটা যদি বিনা দ্বিধায় ওকে তুমি বলতে পারে, তবে ও পারবে না কেন?
আমার–আমার যে কেমন লাগছে তা আমি তোমাকে বোেঝাতে পারব না সালমা। আমি আবার কমার্সের লোক কি না, যোগ-বিয়োগের হিসাবটা বেশি বুঝি। নিজের নিঃসঙ্গতা রঙিন করে ভরিয়ে তোলার মতো ভাষা আমার জানা নেই।
সবসময় ভাষা দিয়ে কি কাজ হয়?
তা হয় না। তবু টেলিফোন যখন, তখন ভাষাটাই অবলম্বন করতে হয় বৈকি।
তুমি বেশ লোক।
কেন?
বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পার।
অপর প্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে। চমৎকার ভরাট গলা। ভঙ্গিটা নিভাঁজ। সালমা মনে মনে সেই অদৃশ্য ব্যক্তির চেহারার একটা ছক কাটে। নাক, চোখ, মুখ, ভুরু, চিবুক, চুল, হ্যাঁ ঠিক এরকম হতে পারে। রংটা শ্যামলা। দীঘল চোখে অনেক ভাষা। নিঃসঙ্গতা যাকে যাতনা দেয় তার মধ্যে নির্ঘাত একটা ভাবুক মন আছে। সে মন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহে। সে ফেরারি মনের কি ঠিকানা আছে?
সালমা।
ধক করে ওঠে সালমার বুক। কে যেন খুব কাছে থেকে প্রিয় নামে ডাকল। উষ্ণ সান্নিধ্যে ভরা সেই কণ্ঠ। একটু থেমে সালমা উত্তর দেয়।
বলো।
চুপ করে গেলে কেন?
তুমিও তো কিছু বলছ না। ও হ্যাঁ, শোনো, তুমি কিন্তু বেশ আমার নামটা জেনে নিয়েছ। এবার তোমার নামটা বলল।
না-ইবা জানলে। থাক না।
মন্দ বলোনি। না জানার মধ্যে মাধুর্য বেশি।
আবার হাসি। হাসির শব্দ মাতিয়ে তোলে সালমাকে।
তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে।
মোটেই না।
কেন? কেন?
বাঃ, তুমি দেখছি একরেই সব জানতে চাও।
ও তাই তো, আস্তে আস্তে সব জানা উচিত। তুমি কী করো সালমা?
পড়ি।
কী পড়?
অনার্স থার্ড ইয়ার।
কোন বিষয়ে?
দর্শন। তুমি কী করো?
চাকরি।
কী চাকরি?
ধরো ছোটখাটো একটা কিছু।
তার মানে তুমি বলবে না।
আবার হাসি শোনা যায়।
সালমা আমার নিঃসঙ্গতা কেটে যাচ্ছে। মনে হয় তোমার সঙ্গে থাকলে আমি কোনোদিন নিঃসঙ্গ হব না।
যাঃ বাজে কথা! সব মানুষই ব্যাসিকালি নিঃসঙ্গ। তাকে ভরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আমার মোহ যখন কাটবে তখন তুমি আবার নিঃসঙ্গ হবে। ক্লান্তিতে পেয়ে বসবে তোমাকে।
তুমি তো অনেক বোঝ দেখছি। তুমি বলে দাও সালমা, আমার এ অনন্ত শূন্যতা কী দিয়ে ভরাব?
জানি না।
তুমি জানো।
জানি না।
সালমা–প্লিজ।
আমি জানি না, জানি না, জানি না।
সালমা?
শূন্য কণ্ঠ ভেসে আসে ওপার থেকে। মনে হয় এই মুহূর্তে সবকিছু হারিয়ে লোকটা নিঃস্ব হয়ে গেল। আর কোনো কথা বলতে পারছে না।
চুপ করে গেলে কেন?
এবার তুমি কিছু বলো।
কী খেলে মিউজিকের রং দেখা যায় তুমি জানো?
জানি।
বলো?
মারিজুয়ানা।
তুমি খেয়েছ কখনো?
নিয়মিত খাই।
লাইনটা কেটে যায়। সালমা আর যোগাযোগ করতে পারে না। যন্ত্রটার ওপর রাগ হয়। কেন যে কেটে গেল লাইনটা! অনেকক্ষণ বসে থাকে। ভাবে হয়তো আবার ফোনটা বাজতে পারে। কথায় কথায় নাম্বারটা রাখা হয়নি। রাখলে ও নিজেই যোগাযোগ করতে পারত। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। মারিজুয়ানা? মারিজুয়ানার কথা আর জানা হলো না। দশ-পনেরো মিনিট বসে থাকার পরও টেলিফোন এলো না। দেয়ালে টাঙানো বাবা-মায়ের বড় আকারের বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে সালমা। মনে হয় ওর চোখের সামনে ওই ছবিটার রং ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। সাদা এবং কালো ছবিটা রঙিন হয়ে গেছে। বাবার মুখটা প্রকাণ্ড তিমির মতো দেখাচ্ছে। মা হয়ে গেছে ছোট্ট একটা সোনালি মাছ। পেছনের দেয়ালটা সাদা সমুদ্র যেন। সালমা অপলক তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। টেলিফোন বাজে। সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। সেই অদৃশ্য বন্ধু যদি হয়?
হ্যালো?
জাহিদ চৌধুরী আছেন?
না, বাইরে গেছেন।
কখন ফিরবেন?
রাত দশটার দিকে।
আপনি ওনার কে হন?
কেউ না।
একটা খবর ছিল বলতে পারবেন?
না।
সালমা টেলিফোন রেখে দেয়, বিরক্ত লাগে। এই কণ্ঠ তো শুনতে চায়নি। যাকগে। কিন্তু লোকটাকে ও মিথ্যে কথা বলল কেন? সত্যি কি জাহিদ চৌধুরী ওর কেউ হয় না, সালমা বুকের ওপর হাত রাখে। হৃৎপিণ্ড এক তালে ধুকধুক করছে। জাহিদ চৌধুরী কেউ না হলে এ শব্দ পেল কোথা থেকে? তবু শরীর ঝাকিয়ে ও অস্বীকার করল সত্য। জাহিদ চৌধুরী ওর কেউ না, কেউ না। ওই নামটা একটা পোকার মতো লাগে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও। বারান্দার বাতিটা বন্ধ করে দেয়। আলো ভালো লাগছে না। এখন চাই অন্ধকার-মূন্ময়ী অন্ধকারের সখী খেলা। সাকিবের ঘরে আলো নেই একটু পরে খুট করে দরজা খুলে ওরা বেরিয়ে আসে। বারান্দায় ওকে দেখে দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
অন্ধকারে কী করছিস দিদিভাই?
এমনি হাঁটছি।
মিতালি তোর সঙ্গে গল্প করতে চাইছিল—
হ্যাঁ সালমা আপা, আপনি যেন কোথায় উধাও হলেন। ওর কথার মধ্যে ছেলেমানুষি ভঙ্গি আছে। সাকিবের সঙ্গে বেশ মানায়। সালমা হাসে। ওর কথার উত্তর দেয় না। জানে বড় বোনের মান রাখতে ও কথা বলেছে সাকিব। ওইটুকু তো ভদ্রতা। নইলে আর কী। মুখে অমায়িক হাসি টেনে বলে, তুমি একলা কী করে যাবে মিতালি?