কী দেখছ আপামণি?
পাখি।
পাখি? এটা তো পরী ঘুঘু। খুব সুন্দর না?
তুমি অনেক পাখি চেনো, না জলিল ভাই?
পাড়াগেঁয়ে মানুষ, পাখি চিনব না? ছোটবেলায় বাটুল দিয়ে কত ঘুঘু মেরেছি। বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কেবলই তো পাখি খুঁজতাম।
ইস, আমার যদি তোমার মতো একটি ছোটবেলা থাকত!
জলিল মিয়া হাসে। সে হাসিতে সালমার বুকটা শূন্য হয়ে যায়। কী যেন পাওয়া হয়নি জীবনে অনেক কিছু দেখাও হয়নি। শুধু চোখের দেখা নয়। নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আপন করে দেখা। ওই ঘুঘুর গাজুড়ে যেমন সাদা ফোঁটা, তেমনি ফোঁটার মতো শূন্যতা থৈথৈ করছে অন্তরজুড়ে।
আবার কী ভাবো আপামণি?
তোমার গল্প বলো জলিল ভাই।
আমার আবার কী গল্প!
কেন তোমার তো কত কথা আছে। খেয়া বাইতে, মাছ মারতে, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রা শুনতে, বরদার সঙ্গে প্রেম করতে
এসব আবার একটা কথা নাকি?
আচ্ছা জলিল ভাই, ছোটবেলায় তুমি খুব ডানপিটে ছিলে না?
খুব। কারো কথা শুনতাম না। যা খুশি তাই করতাম। এই খামখেয়ালি মনটার জন্য আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে গেছি আপামণি।
জলিল মিয়া বিড়ি ধরায়। সালমার মনে হয় জলিল মিয়ার চুল যেন আরো পেকেছে। সাদার ভাগই বেশি। খামখেয়ালি মন নিয়ে কেবল কি জ্বলে-পুড়েই মরে মানুষ? জলিল মিয়া কি বৃদ্ধ বয়সে অনুতাপ করছে? সালমা বুঝতে পারে না কিছু।
জলিল ভাই বরদা এখন কী করে?
কী আর করবে। ভাইয়ের সংসারে আছে। কচুর শাক, কলমিলতা বিক্রি করে দিন চালায়। জানো আপামণি, বরদা আমাকে খুব ভালোবাসত। কতদিন আমার বুকে মাথা রেখে কেবলই কেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই হেরে গেল ও। কিছুতেই পারল না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলেছিলাম গাঁয়ে থাকব না, অন্য কোথাও চলে যাব। তাও রাজি হলো না।
আমড়া ডালে ঘুঘুটা তখনো বসে আছে। জলিল মিয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়িটা শেষ হয়ে এসেছে। কোনো একটা মেয়ে জলিল মিয়াকে ভালোবেসে পরে বিয়ে করেনি। এজন্যে তার মনে অনেক দুঃখ থাকতে পারে, সালমার তাতে কিছু এসে যায় না। জলিল মিয়ার ছেলেবেলাটাই বেশি ভালো লাগে। বর্ষার করতোয়ায় জাল ফেরে মাছ ধরার দৃশ্য কল্পনা করতে করতে শিউরে ওঠে ও। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে কাদাপানি ভেঙে মামার বাড়ি চলে যাওয়াটা আশ্চর্য লাগে। এমন দিন সালমার জীবনে একটাও আসেন্Pি পাখি খুঁজতে খুঁজতে গভীর বনে। হারিয়ে যায়নি ও। সাতসকালে গোসাইবাড়ির বিছানো বকুল ফুল পাগলের মতো দুহাতে তুলে কেঁচড় ভরেনি। মনে হয় অনেক কিছু বাকি রয়ে গেল। এই না করতে পারার বেদনা শূন্যতা হয়ে কষ্ট দেয়।
ওই লোকটা একটা বিরাট ফাঁকিতে পড়েছিল বলে এখন অনুতাপ করে। কিন্তু কেন? ওর মতো বৈচিত্র্যময় জীবনই বা কয়জনের হয়? সালমা ভাবল, আসলে কোনোকিছু নিয়েই অনুতাপ করা ঠিক নয়। প্রত্যেক ঘটনাকে যদি নিজের কাজের অঙ্গীভূত করে না নেওয়া যায় তাহলে দুঃখ বাড়ে। বুক ভেঙে আসতে চায়। যে যা করে তা তার নিজ দায়িত্বে করে। তার জন্য আবার অনুতাপ কিসের? সেটা নিজের দুর্বলতার লক্ষণ। সালমার মোটেই পছন্দ নয়। শ্বেতকরবী গাছের ডালে একজোড়া বুলবুলি লাফাচ্ছে। সাদা ফুলগুলো বুক চিতিয়ে হাঁ করে আছে। সালমা সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, তুমি অনেকদিন গ্রামে যাওনি জলিল ভাই?
যতদিন বরদা বেঁচে থাকবে, ততদিন গ্রামে যাব না।
কোনো মানে হয় এসব সেন্টিমেন্টের!
কী বললে?
বললাম তুমি একটা কাপুরুষ। কী এমন অন্যায় করেছ যে পালিয়ে বেড়াতে হবে?
না, পালানো নয় আপামণি। ওর জন্য যাব না। গতবার যখন গেলাম তখন খুব কেঁদেছে। আমি গ্রামে গেলে দশজনে ওকে দশ কথা বলে। অপবাদ দেয়।
তাতে তোমার কী? আর একটু সাহসী হলে তো ওই অপবাদ ওর জন্য আশীর্বাদ হতো।
ওইসব কথা থাক আপামণি।
আমি একবার তোমার সঙ্গে গ্রামে যাব। দেখব তোমার। ছেলেবেলাটা খুঁজে পাই কি না।
জলিল মিয়া হো হো করে হাসে। সালমা চুপ করে থাকে। আনমনে তাকায়। কখন যেন আমড়ার ডাল থেকে ঘুঘুটা উড়ে চলে গেছে। বিকেল নাচছে কৃষ্ণচূড়র পাতায়। গোলাপি চেরিফুলের গাছটা যৌবনে ফেটে পড়ছে। ডালগুলো নুয়ে গেছে। জলিলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে যায় সালমা। ওই হাসি কোনোদিন দেখেনি। আস্তে আস্তে বলে, সত্যি বলছি জলিল ভাই, আমি তোমার সঙ্গে একবার গ্রামে যাব। একটু মিথ্যে নয়।
যেয়ো, আপামণি যেয়ো।
জলিল মিয়া অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। করতোয়া পাড়ের গ্রামে তখন শেষ বিকেলের আলো। বাঁশঝাড়, কদবেল গাছ, বনবরির ঝোপ এড়িয়ে চিকন রাস্তা গিয়ে নেমেছে নদীর পাড়ে। পায়ে পায়ে বাজে ঝরাপাতার শব্দের নূপুর। চারদিকে গাছগাছালি ঘাস-লতাপাতা-ফুল মাথা নাড়িয়ে চলেছে। সালমার কানে নদীর শব্দ স্পষ্ট হয়ে। ওঠে। ভরাট নদী। চিকচিকে বালি। এবড়ো-থেবড়ো পাড়। সুরভি মাখানো বাতাসের আস্বাদ পায় সালমা। ছটফট করে ওঠে মন। উঠে হটতে থাকে। বারান্দায় উঠে আসে। বাবা-মার ঘরে টেলিফোন বাজছে। অনেকক্ষণ বাজার পর সালমা এসে টেলিফোন ধরে।
হ্যালো।
কে বলছেন?
আমি সালমা। আপনি কাকে চান?
আপনাকেই।
আমাকে?
হুঁ।
আপনি কে?
চিনবেন না।
আমাকে কিছু বলবেন?
দেখুন, আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
সালমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ দম আটকে আসছিল।
আপনি কী করছিলেন?
বাগানে বসেছিলাম।
জানেন টেলিফোন নাম্বার ঘোরাতে ঘোরাতে আমার মনে হয়েছিল যে একটি মেয়ে পাব, যে এক সেকেন্ডে আমার মুহূর্তগুলো ভরে দিতে পারে।