ঠিকই বলি। তুই একটা হাঁদা মেয়ে।
নাসিমা কথা বলে বাহুতে মাথা চেপে রাখে। সালমা অসহায় বোধ করে। উঠবে না বসবে বুঝতে পারছে না। বেহালা শেষ হয়ে গেছে। বাঁশির একটা রেকর্ড বাজছে এখন। নাসিমা মাথা তোলে।
দেখছিস সালমা, কেমন ধূসর রঙে ভরে গেছে সব দিক।
সালমা হা না কিছু বলল না। কথা বলা বৃথা। শোবারঘরে থেকে সাব্বির ভাই এলো টলতে টলতে। সালমাকে দেখে হাসল। হেই করে শব্দ করল। ফ্রিজ খুলে দুই বোতল পানি খেল। তারপর আবার চলে গেল। এতক্ষণে সালমার অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। বুঝল দুজনেই নেশাগ্রস্ত। কিন্তু কী খেলে মিউজিকে রং দেখা যায়? ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। এ জিনিস খেতেই হবে। নাসিমা আবার নিজের মধ্যে তলিয়ে গেছে। কুচকুচে কালো চুলের ঝরনা নেমেছে ডিভানের গা বেয়ে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় সাদা পিঠ দেখা যাচ্ছে। ব্লাউজের অর্ধেক বোতাম খোলা। হাত দুটো শিথিল। ঝুলছে। সালমা তাকিয়ে আছে; কিন্তু কোনো কিছুই দেখছে না। মাথার মধ্যে ঘুরছে একটি শব্দ। মিউজিকের রং? এ বোধ ওকে পেতেই হবে। মিউজিকে রং না দেখলে সালমা আর টিকতে পারছে না। হাতের ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। চুপচাপ পা ফেলে বেরিয়ে আসে। সাকিবকে জিজ্ঞেস করা যায়। ও কি জানে কী খেলে মিউজিকে রং দেখা যায়!
সাকিবের ঘরের সামনে এসে থমকে যায় সালমা। দরজা বন্ধ। সাদা ধবধবে পর্দা বাতাসে দুলছে। সাকিবের নিস্পাপ চেহারার মতো ভেতর থেকে হাসির শব্দ আসছে। সালমার রাগ হয়। চনচনিয়ে ওঠে সাদা রাগ। দরজার গায়ে লাথি মারে।
কে?
ভীষণ মোটা গলা সাকিবের! এমন করে তো ও কখনো কথা বলে। আজ কেন বলছে? তবে কি ও মিতালির গা থেকে সুগন্ধি বের করে নেশা করছে? সালমা একদম চুপসে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় ওর। সাকিব নেশাগ্রস্ত। এখন কিছুতেই দরজা খুলবে না। সালমা বোেকার মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা এখন মিউজিকে রং দেখতে পাচ্ছে। সালমার বিষণ্ণ মুখটা কালো হয়ে আসে। সাকিব দরজা খোলে না। ওই একটা শব্দ মোটা গলায় উচ্চারণ করে চুপ করে যায়। ওর কোনো গরজ নেই, যেহেতু দরজার গায়েও আর কোনো শব্দ নেই। যে পর্দাটাকে সাকিবের চেহারার মতো নিস্পাপ মনে হয়েছিল তার রং বদলে যায়। বারান্দায় এমাথা-ওমাথা জুড়ে পায়চারি করে।
সালমা একসময় সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায়। জলিল মিয়া এখনো বাগানে কাজ করছে। বিরাম নেই লোকটার। করতোয়া পাড়ের ছেলে। গায়ের মধ্যে নদীর মতো শক্তি। ফুলে ফুলে উঠে বান ডাকিয়ে দেয়। গেট দিয়ে হাফিজ ঢোকে। এ বাসায় প্রায়ই আসে ছেলেটা। সোজাসুজি সামনে এসে দাঁড়ায়। শরীরজুড়ে একটা দীন ভঙ্গি। ওকে দেখলে রাগ হয় সালমার।
স্যার নেই?
না।
কোথায় গেছেন?
ফাংশনে।
কখন ফিরবেন?
রাত হবে।
ও তাহলে যাই।
ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটি। বিনীত ভঙ্গিটা সালমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। অসহ্য! ছেলেটা চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সালমা ডাকে।
শুনুন।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ। বাবার কাছে আপনার কী দরকার?
স্যার বলেছিলেন আমাকে একটা চাকরি দেখে দেবেন। একটা চাকরি আমার খুব দরকার।
বেশ তো ভালো কথা। চোখা ছেলের মতো চোখেমুখে কথা ফোঁটাতে পারেন না? অমন জবুথবু হয়ে থাকেন কেন?
মানে–কী বলছেন?
এমএ পাস করেছেন?
হ্যাঁ, গত বছর। স্যার আমাকে খুব ভালো জানেন। আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম।
ও সেই কাগুজে ডিগ্রি। এজন্যে রোজ রোজ স্যারের পায়ে ধরতে আসেন।
কী বললেন?
বাবা আপনাকে কোনোদিন চাকরি করে দেবে না।
উনি কথা দিয়েছেন।
তাতে কী? ওরকম কথা উনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে দেন। দেখেন না, বাবা বক্তৃতায় এ কথা বলে, কাজে আর এক কথা করে।
হাফিজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না। স্যারের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন?
আপনারা এমনি পাশ কাটিয়ে যান বলে আর কিছু ভাবতে পারেন। আপনাদের মতো ছেলেদের মাথা ভাঙিয়ে বাবা খায়। আপনি না অনেকদিন বাবার বক্তৃতা লিখে দিয়েছেন, প্রবন্ধ লেখাতে সাহায্য করেছেন? বিনিময়ে কী পেয়েছেন? আপনাদের মতো ছেলেদের মাথাগুলো হলো সিঁড়ি। তার ওপর পা রেখে আমার বাবা ওপরে ওঠে। যতদিন আপনাকে প্রয়োজন ছিল ব্যবহার করেছে। এখন নেই। এজন্যে বাবা আপনার দিকে ঘুরেও তাকায় না। বাবার পিছে পিছে ঘুরে এবার নিজে নিজে একটা চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করুন।
সালমা হাফিজকে উপেক্ষা করে বাগানে চলে যায়। একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গেট খুলে বেরিয়ে যায় হাফিজ। গেটটা খোলাই থাকে। হতাশ মর্বিড টাইপের ছেলেদের মোটেই পছন্দ হয় না সালমার। ওরা বেপরোয়া না হয়ে অনবরত নত হতে থাকে। বাবার কাছে কেবল আসে আর যায়। একদিনও বাবার সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারল না। জোর দিয়ে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। বাবা যা বলে তা শুনে চলে যায়।
কামিনী ফুলগাছটার নিচে জলিল মিয়া বিশ্রাম নিচ্ছে। বাগানের কাজ আজকের মতো শেষ। সালমা রক্তকরবী গাছটার নিচে দাঁড়ায়। পেছনের আমড়া ডালে একটা চমৎকার ঘুঘু বসে আছে। সালমা আগ্রহ নিয়ে দেখে। পাখিটার ঘাড়ের চারপাশে কলার আছে এবং তার ওপরে নিচে দুটো সাদা ডোেরা আছে। গায়ের রং হালকা বাদামি। মাথায় ধূসর রঙের ওপর কিছুটা জলপাই রঙের ছাপ আছে। সালমা মনে মনে ভাবে, ঘুঘুটা ডাকে না কেন? ডাকলে বেশ হতো। মিশন হাসপাতালে উদাসী দুপুরগুলো ফিরে পেত যেন। ফিরে পেত কৈশোরের কতকগুলো টুকরো টুকরো স্মৃতি। আশ্চর্য, শুধু একটি শব্দ দিয়ে বিস্মৃত অতীতকে কেমন অনায়াসে ফিরে পাওয়া যায়। গোটা ছবিটা এক ঝলকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় সেই কৈশোরটা ডেকে উঠেছে ঘুঘু-ঘু-ঘুঘু।