তলিয়ে যেতে যেতেও ভুস করে ভেসে ওঠে এক এবং একাধিক শব্দ। ফুরফুরে বাতাস-সাকিবের বাজনা-মৃন্ময়ী অন্ধকার ইত্যাদি সালমাকে নাগরদোলার মতো দোলায়। দোলাতে দোলাতে ঘুম পাড়ায়। দুসপ্তাহ একনাগাড়ে ক্লাস করতে করতে আবার হাঁপিয়ে ওঠে সালমা। ক্লান্তিকর। বাবার লেকচার, ড. হায়দারের লেকচার, মমতাজ আপার লেকচার কিছুই ভালো লাগে না। পুরনো গৎ বাঁধা পড়া। মোটেই সুবিধে নয়। যেসব বই ঘেঁটে ওরা পড়ায় সেইসব বই সালমা বাসায় কয়েকবার পড়েছে। ওরা কেউ নতুন কথা বলে না। কোনো নতুন দর্শনের কথা বলে সবাইকে চমক দিতে পারে না। ছাত্রছাত্রীর চিন্তাশক্তি আলোড়িত করে না। কপচানো বুলির নোট লিখে, আবার সেগুলো মুখস্থ করে উগরে দিতে হবে। এই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি জুটবে। ভাবতে বিশ্রী লাগে ওর। আবার সেই নসিয়া। মনে হয় বাবা সেই ধরনের পণ্ডিত হোক যে একটা তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে নাড়িয়ে দিক বিশ্বকে।
বাবা কিছু পারে না। কেননা বাবার মধ্যে ক্ষমতার লোভ, বিদ্যাবুদ্ধির অহংকার, সভ্যতার মেকি নিষ্প্রাণ আদবকায়দা, অর্থের চিন্তা, নানাবিধ ক্রিয়া সমানভাবে কাজ করে। বাবা নিজেকে জয় করে শক্তিমান হতে পারেনি। মাঝে মাঝে সালমার ভীষণ ইচ্ছে করে একজন শক্তিমান পুরুষের মুখোমুখি হতে, সে শক্তিমানের পায়ে নিজেকে লুটিয়ে দিতে। অন্যেরা যত কথাই বলুক আসলে বাবা বিদ্বান, কিন্তু জ্ঞানী হতে পারেনি। যে নিজেকে জানে না সে জ্ঞানী হয় কী করে? অন্যকে জেনে বিদ্বান হওয়া যায়, কিন্তু নিজেকে না জানার অক্ষমতায় সব জ্ঞান চাপা পড়ে। সালমা মনে মনে আবার সেই নিজস্ব প্রার্থনা করে, তুমি জাহিদ চৌধুরীই থাক, আমার বাবা হতে এসো না। তোমার মতো বাবা আমার জীবনে না থাকলেও চলে। আমার মতো মেয়েও তোমার হয়তো খুব একটা দরকার নেই। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পার না। তোমার অক্ষমতা আমার লজ্জার কারণ। তোমার মধ্যে সেই শক্তিমান মানুষ খুঁজে পাই না বলে আমার নসিয়ার মতো লাগে। কী যে বিশ্রী ব্যাপার বাবা, সে তুমি বুঝবে না। যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে একটি আশ্চর্য অনুভূতিও দানা বাঁধে। নিজের সঙ্গে নিজের এক অবিরাম যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধের কোনো পরিণতি নেই।
সেদিন বিকেলে বাবা-মা দুজনে বাইরে গেল। মা কী ভীষণ সেজেছে! অত উৎকট সাজের প্রয়োজন ছিল কি? এজন্যে মার ওপর রাগ হয় সালমার। রুচিসম্মতভাবে সাজতে জানে না। যা তাকে মানায় না তাই তার করা চাই। বাবাও কিছু বলে না। বলবেই কী? বাবা ভাবে যে-কোনো উপায়ে নিজেকে প্রদর্শনীর সামগ্রী করে তোলাটাই আর্ট। বাবা এর বেশি কিছু ভাবতে পারে না। মাকে নিজের চিন্তার মধ্যে আনতে পারে না সালমা। মার কড়া কমলা রঙের শাড়িতে চোখ ধাধিয়ে যায়।
আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি লিমা। ফিরতে রাত হবে।
সালমা ঘাড় কাত করে। বসার ঘরে সাকিব মিতালির সঙ্গে গল্প করছে। মিতালি যে এসেছে বাবা-মা কেউ টের পায়নি। সালমা এখন একা একা কী করবে ভেবে পেল না। মনে হলো সুখ-দুঃখের কথা। জলিল মিয়া বাগানে পানি দিচ্ছে। গরুম হওয়া বইছে চারদিকে। সূর্যের তেজ কমেনি। সালমা বাড়ির পেছনদিকে ওর নির্জন পৃথিবীতে এলো। সুখ-দুঃখের বাক্স খুলে বের করে দিলো। ওরা লাফাতে লাফাতে বাগানের ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হলো। পাতা ঝরার পালা শেষ। আমের বোল এসেছে। চমৎকার গন্ধ ভাসছে। আর সব গাছে নতুন পাতা। কচি পেলব। হাত দিয়ে ধরলে মাখনের মতো লাগে। ঝরা পাতার মৌসুম নেই বলে চারদিক ছিমছাম লাগছে। বাগানটাকে মনে হয় অনেক হালকা। কোনো বোঝায় ভারাক্রান্ত নয়। সালমার নিজেরও ফুরফুরে লাগে। আমের বোল ঝরে পড়ে পাতার ওপর। খরগোশ দুটো পায়ের কাছে এসে মুখ ঘষে। আবার দৌড়ে চলে যায় অন্যদিকে। ওরা বেশ খেলায় মেতেছে। অনেক দিন পর আজ ছাড়া পেয়েছে। জলিল মিয়া খরগোশ দুটোর যত্ন করে, কিন্তু সালমা বাগানে না এলে ওদের ছেড়ে দেবার নিয়ম নেই। সালমার ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির লাগে। ওই খরগোশ দুটোর মতো ছুটোছুটি করতে ইচ্ছে করে। ঘাসের বুকে, পাতার আড়ালে লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। নিজের সঙ্গেই নিজের খেলতে সাধ হয়। সালমা আতা গাছটার ছোট কাণ্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। দোতলা থেকে হিন্দি গানের সুর ভেসে আসছে। মনে পড়ে, নাসিমা ওকে যেতে বলেছিল। নাসিমা কেন ডেকেছে কে জানে। হয়তো কোনো নতুন রেকর্ড কিনেছে, সেটা শোনার জন্য। এখুনি একবার গেলে মন্দ হয় না। বিকেলটা ভালোই কাটানো যাবে।
সালমা ফিরে আসে। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে সাকিব নেই। ওর ঘর থেকে দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে। বাবা-মা নেই বলে সাকিব মিতালিকে শোবার ঘরে নিয়ে গেছে। সালমার হাসি পেল। ওদের বিরক্ত
করে সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ উঠে গেল। বাইরের দরজা খোলা। ভেতরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ বলে ঘরের মধ্যে আঁধার আঁধার ভাব। নাসিমা ডিভানের ওপর কাত হয়ে শুয়ে আছে। পিঠের ওপর কুচকুচে কালো চুলের গোছা ছড়ানো। মুখে কেমন একটা হাসি।
সালমার অন্যরকম লাগে। চেঞ্জারে বেহালা বাজছে।
আয় সালমা, বোস।
সালমা একধারের সোফায় বসে।
এই মিউজিকের রংটা খুব সুন্দর না?
মিউজিকের রং?
হ্যাঁ, তুই দেখতে পাচ্ছিস না? ওই দেখ কেমন বেগুনি রং পরাগ হয়ে ছড়িয়ে গেছে সারাঘরে।
কী যে বলো নাসিমা’পা।