কিসের বন্দোবস্ত? সালমা ভুরু কোঁচকায়।
বুঝতে পারছিস না, বিয়ে—
বিয়ে? আমাকে বলতে এলে দেখাবা
সালমা উঠে পড়ে। ঘুরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। কাপড় ছাড়ে। বাথরুমে যায়, হাতমুখে পানি দেয়। শব্দটা খচখচিয়ে ওঠে মনে। বিয়ে? বিয়ে? অসম্ভব। কখনো মধুর আমেজের মতো লাগে। আবার বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। না, একঘেয়ে ক্লান্তিকর। জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয়। রুবা ভাবির কথা মনে পড়ে। অনেকদিন রুবা ভাবির ওখানে যাওয়া হয়নি। কতদিন হলো? প্রায় মাসতিনেক। রুবা ভাবি ঠিক রাগ করবে। কাল-পরশু একবার যেতে হবে।
০৩. টেবিল-বাতি জ্বালিয়ে একটা বই নিয়ে বসে
টেবিল-বাতি জ্বালিয়ে একটা বই নিয়ে বসে। পড়া হয় না। বাতিটা। আবার বন্ধ করে দেয়। কালো অক্ষরগুলো মুছে গিয়ে একটা শব্দ জেগে থাকে। বিয়ে। রুবা ভাবি বিয়ে করেছে এবং প্রতিবছর বিয়ের মাসুল ওঠাচ্ছে। নাসিমা আপা বিয়ে করেনি। বিয়ে না করেও বিবাহিত জীবনযাপন করছে। তাহলে বিয়ের অর্থ? কেমন করে এ শব্দ জীবনের সব সত্যকে উদ্ঘাটন করে? সালমা টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। ঘুরেফিরে রুবা ভাবির কথা মনে হয়। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। হাসিখুশিতে ভরা মেয়ে রুবা ভাবি। শিহাব ভাইও ভালো। বিয়ের পাঁচ বছরে চারটে সন্তানের বাবা হয়েছে। চিন্তা নেই। সালমা হাসতে হাসতে বলেছিল, এবার ক্ষান্ত দাও রুবা ভাবি।
পাগল। পেটে বাচ্চা না থাকলে আমার ভালো লাগে না রে। যেদিন বুঝব আর পারি না সেদিন থামব।
সালমা অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়েছিল। গা-টা কেমন ঘিনঘিন করছিল। মন হয়েছিল, রুবা ভাবির সারা গায়ে পোকা কিলবিল করছিল। তখুনি সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ। সেই সাঁওতাল-মা। কালো কুচকুচে পেটানো শরীর। বাচ্চা বাঁচত না তার। মনে মনে বলেছিল, তুমিও যদি অমনি হতে রুবা ভাবি তাহলে কেমন হতো? পরে রুবা ভাবিকে বলেছিল, তুমি আমায় অবাক করলে রুবা ভাবি। বিয়ের দায় কি এমনি করে ওঠাতে হয়?
কেন? কেন?
তোমার যদি এতই শখ তাহলে তুমি কুমারী অবস্থায় মা হতে পারনি কেন?
তুই একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস সালমা।
ঠিক আছে, না হয় তাই হলাম। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
জানি না।
তখন তোমার পেট খালি লাগেনি?
আঃ, সালমা!
জানি তো উত্তর দিতে পারবে না।
এসব কথা বলতে নেই সালমা।
না, আর বলব না।
সালমার এ ধরনের বেয়াড়া প্রশ্ন সহ্য করেও রুবা ভাবি ওকে আদর করে। সালমা গেলে কী করবে বুঝতে পারে না। কত কী যে খাওয়ায় তার ঠিক নেই। অথচ রুবা ভাবির বাচ্চাদের সালমা একদম সহ্য করতে পারে না। একটাকে থামালে আরেকটা শুরু করে। মারামারি, হৈচৈ, কান্নাকাটি সে এক বিশ্রী ব্যাপার। সালমা চোখ বুজে সেই কান্না যেন শুনতে পেল। হাসল আপন মনে। তবু রুবা ভাবি বেশ আছে। কোনো চাঞ্চল্য নেই। কিন্তু রুবা ভাবি যা পারে, সালমা তা পারে না। ওইসব চিন্তা করলে শরীর শিরশির করে।
আপামণি। হরলিকস।
আনুর মা এক গ্লাস হরলিকস টেবিলে রাখে।
বাবা কী করছে আনুর মা?
পড়ছেন।
মা?
রান্নাঘরে।
রাতের রান্না কী?
মাংসের ভুনা, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজি, বেগুন ভাজা।
মন্দ না। তুমি বসো ওইখানে।
সালমার আদেশে আনুর মা মেঝের ওপর বসে পড়ে। আনুর মাকে জানার খুব ইচ্ছে ওর, কিন্তু ও তেমন করে কোনো উত্তর দিতে পারে না। আসলে হয়তো গভীর কিছু ভাবে না।
আচ্ছা আনুর মা, আমাদের সঙ্গে থাকতে তোমার কেমন লাগে?
কেমন-টেমন বুঝি না। পেটের দায়ে থাকি।
তোমার স্বামী নেই, মেয়েটাও কাছে নেই, তোমার খারাপ লাগে না?
সারাদিন কাজে থাকি। রাতে শুলেই ঘুম আসে। আর কিছু জানি। ওই আম্মা ডাকে। আনুর মা একরকম দৌড়ে চলে যায়। সালমার রাগ হয়। কোনো কাজের না। নিজেকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। বেশি কিছু বোঝেও না। সালমা হরলিকস খায়। টেবিল-বাতিটা আবার জ্বালে। পড়তে বসে। আস্তে আস্তে মনোযোগ বাড়ে। কালো কালো অক্ষরগুলো মনে হয় খুব পরিচিত। ওরাই তো দিনরাত সালমার অন্তরের কাছে বসে কথা বলে।
রাতের খাবার টেবিলে বাবা খুব গম্ভীর হয়ে যায়। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না। কথা বেশি বলে সাকিব আর। সালমা আড়চোখে বাবার মুখের দিকে তাকায়। ওর ওপর অসন্তুষ্ট হলো কি না বুঝতে পারে না। অল্প একটু খেয়ে উঠে পড়ে।
কী, হয়ে গেল তোমার?
বাবার গম্ভীর কণ্ঠ। সালমা থতমত খেয়ে যায়।
এই মাংসটুকু খাও।
খেতে ইচ্ছে করে না।
খেতে হবে।
সালমা আর কোনো প্রতিবাদ না করে বসে পড়ে। মাংস খেয়ে উঠে যায়। বাবা আর কিছু বলে না। খাওয়া-দাওয়ার পর সাকিব বারান্দায় গিটার নিয়ে বসে। সালমা দরজা-জানালার পর্দা খুলে দিয়ে শুয়ে থাকে। ক্রস ভেন্টিলেশনের দরুন ফুরফুরে বাতাস আসছে। এক ঝাপটা করে ফুলের গন্ধও আসে কখনো। বাইরে আমগাছের মাথায় অন্ধকারের মৃন্ময়ী ইচ্ছেগুলো আড়ি আড়ি খেলে। পাতায় পাতায় অশরীরী স্পর্শ। চোখ বুজে থাকতে কী ভীষণ আরাম লাগছে! গিটারের বাজনা ছন্দ তুলে ভাসছে। কখনো মৃদু। কখনো তীব্র। সালমার মনে হয়, ও আস্তে আস্তে এক বিরাট আঙর ক্ষেতে ঢুকে যাচ্ছে। থােকা থােকা রসাল ফলের মতো মাতাল আবেগ ওর অনুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ও হাঁটছে। কেবলই হাঁটছে। চারদিকে রসাল ফল। সবুজ পাতা। আর কিছু নেই। ওর মনে হয় কিছুর দরকার নেই। এমনি করে ও অনন্তকাল কাটাতে পারে। সালমা তলিয়ে যাচ্ছে।