আস্তে আস্তে ভালো হয়ে গেল সালমা। আর বাবাকে কেন্দ্র করে সেই দিনগুলো সালমার জীবনে স্মৃতি হয়ে রইল। গরমের ভীষণ দুপুরে ওই স্মৃতিটুকু ছাড়া বাবাকে কেন্দ্র করে আর কোনো অনুভূতি কাজ করে না। মনে মনে বিড়বিড় করে, তুমি অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরীই থাকো। আমার বাবা হতে এসো না।
দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। সালমার বিরক্তি লাগে। দুপুরটা বেশ জমে উঠেছিল। এ সময়ে আবার কে এলো?
দিদিভাই? অ দিদিভাই?
কী?
রকিব ভাই এসেছে।
আসছি।
রকিব এসেছে। মন্দ না। সময়টা কাটবে। রকিব প্রায়ই আসে। এ বাড়িতে ওর অবাধ যাতায়াত। কেউ কিছু মনে করে না। ভয়ে ভয়ে মা কখনো আপত্তি করে, ছেলেদের সঙ্গে বেশি ঘোরাঘুরি ঠিক নয় লিমা।
বেশি কই দেখলে? তাছাড়া ছেলেদের নয়। রকিব ছাড়া কারো সঙ্গে ঘুরি না। আর ঘুরলেই বা কী, নিজের কাছে যে সৎ থাকে সেই সবচাইতে চরিত্রবান ব্যক্তি।
দেখো মেয়ের কাণ্ড। একটা কথা বললাম, অমনি উনি বক্তৃতা শুরু করলেন।
মা বেগতিক দেখে অন্য প্রসঙ্গে যায়। সালমা গজগজ করে।
তোমরা বড্ড সেকেলে। এজন্যেই তো তোমাদের সঙ্গে আমার মেলে না। দৃষ্টিটা একটু ছড়িয়ে দাও না। যা শিখেছ সেটাই চিরকাল আঁকড়ে থাকবে, নিজে কিছু নতুন করে ভাববে না মা?
তোর মতো একালের মেয়ে আর হতে পারলাম কই?
মা কাজে চলে যায়।
ভাবতে ভাবতে দ্রুত কাপড় পরে নেয় সালমা। চুল আঁচড়ায়। পাউডারের পাফ বুলোয় মুখে। ড্রয়িংরুমে রকিব বসে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। সালমার লঘু পায়ের শব্দ ওর খুব পরিচিত।
কিরে কী করছিলি?
শুয়েছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলি?
না।
চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি।
চল।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে আসে। এ জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। প্রায়ই আসে ওরা। বিছিয়ে রাখা গালিচার মতো সবুজ ঘাস। কয়েক হাত দূরে ঝাঁকড়া মাথা গাছ। সামনে লেকের কাঁপুনি জল। দূরে মিরপুর রোড। সালমার মনে হয় এই সেই নির্জন দ্বীপ। কিন্তু কখনো মিরপুর রোড দিয়ে চলে যাওয়া ডবল ডেকার বাস সব এলোমেলো করে দেয়। ভাবনা তলিয়ে যায়। ভালো করে কিছু ভেবে আর বুঝে উঠতে পারে না। বিকেলের নীলাভ ছায়া লেকের জলে উথালপাতাল। সেদিকে তাকিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সালমা।
কিরে দাঁড়িয়ে যে, চল কোথাও গিয়ে বসি।
দাঁড়া একটু। আচ্ছা রকিব, পাস করে তুই কী করবি?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
বল না।
পাস করে চাকরি নেব।
তারপর?
তারপর চাকরি করতে থাকব।
ধুৎ। তুই সেই রাজপুত্রের কাছে গল্প বলা রাখাল ছেলের মতো বলছিস। কেবলই ফুড়ৎ।
আর কী করব বল? এমনি করেই তো জীবন শেষ হয়ে যাবে।
শুধু একটা কিছু নয়, আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে।
ওতে নাকি জীবনে স্থিতি আসে না। শান্তি হয় না।
কে চায় স্থিতি! কে চায় শান্তি! জীবনটাকে অনবরত ঘোলা করে তুলব।
সালমা?
বল।
এমন করে কী লাভ?
লাভ-লোকসান বুঝি না। চল, ওই গাছটার নিচে বসি।
সালমা পা ছড়িয়ে গাছের তলে বসে। পঁড়িতে হেলান দেয়। চোখ বুজে থাকতে ইচ্ছে করে। রকিব ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়েছে।
সালমা কিছু বলে না। মনে মনে হাসে, রকিবের কি এখন আবাল খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে। রকিব ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়েছে।
রকিব অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। একটা কিছু আঁচ করে। দুষ্টুমির ঝলক সালমার সারা মুখে।
কিরে, কী ভাবছিস?
তোর কী এখন আবাল খেলা খেলতে ইচ্ছে করছে!
যাঃ। কী যে বলিস!
মন্দ কী! এই খোলা মাঠ গাছের নিচ। মনে হবে আমরা দুজন আদম আর ইভ। চারদিকে কেবল অনন্তকালের নীরব প্রকৃতি।
একদম বখে গেছিস তুই।
সালমা জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাঁটুর ওপর মুখটা রেখে চুপচাপ বসে থাকে। ফিকে হলুদ রঙের শাড়ি বিকেলের রোদের মতো। সালমার গায়ের হলুদ রঙের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। হঠাৎ বলে, আচ্ছা, রকিব এখন যদি গাছের ওপর থেকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী কথা বলে ওঠে?
কী কথা?
যদি জিজ্ঞেস করে আমরা কোনো জাদুর কাঠি চাই কি না? তাহলে কেমন হয়?
মন্দ না।
জাদুর কাঠির কাছে তুই কী চাইবি?
আমি চাইব–আমি চাইব–এই দেখ কিছু ভেবে উঠতে পারছি। তুই কী চাইবি?
আমি-আমি–সত্যি তো আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। কী চাইবার আছে?
দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে।
রোদ একদম নেই। বিকেল শেষ, সন্ধ্যাও পুরোপুরি ঘনায়নি। এমনি একটা মাঝামাঝি সময় ওরা উঠে আবার হাঁটতে থাকে। বাড়ি ফেরা দরকার। কেউ কোনো কথা বলে না। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় আসে। নিরিবিলি রাস্তা। লোক চলাচল কম। আশপাশের বড় বড় বাড়িগুলোর জানালা দিয়ে আলো আসছে। ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। সে ফুলের নাম জানে না কেউ।
গেটের সামনে এসে রকিব থমকে দাঁড়ায়।
ভেতরে যাবি না?
না, কাজ আছে। কাল ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিস তো?
দেখি চিন্তা করে।
এমন করলে তুই পাস করতে পারবি না সালমা।
পাস যে করতে হবে এমন কথা কাউকে দিয়েছি নাকি?
সালমা হাসে। রকিব চলে যায়। দোতলার বারান্দায় রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে নাসিমা দাঁড়িয়ে আছে। সালমাকে দেখে হেসে হাত নাড়ে। সালমাও হাসে। কথা বলতে পারে না। বাবা-মা দুজনে বাড়িতে। নাসিমা অনুচ্চ গলায় বলে, কাল সময় পেলে আসিস একবার।
সালমা মাথা নাড়ে। বারান্দায় সাকিব বসে। অবশ্যই বাবা-মার মতো মারমুখী নয়। নাসিমাকে ওর ভালো লাগে। সালমাকে দেখেই সাকিব ডাকে।
শোন দিদিভাই, খবর আছে।
কী? সালমা চেয়ার টেনে ওর কাছে বসে।
বাবা বোধহয় তোর একটা বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করছে। বিকেলে চায়ের টেবিলে সেরকম আলাপ-আলোচনা শুনলাম।