মিনু বউদি ঠাট্টা করত, তুই কি কবি হবি নাকি লিমা? দিনরাত অমন হাঁ করে দেখিস কী বল তো?
কী আবার? গাছ দেখি।
সালমা বেশি কথা বলতে পারত না।
উঁহু, লক্ষণ ভালো না। বাবা এলে বলব, এবার লিমার জন্য একটা টুকটুকে বর দেখতে।
ভালো হবে না বউদি। মিনু বউদি জোরে জোরে হাসত।
তোমার হাতে আমি কিন্তু আর একটুও ওষুধ খাব না। সত্যি বলছি, খাব না। তিন সত্যি করব?
না লক্ষ্মী, না।
বউদি তখন হাসি থামাত। অসুখের জন্য সালমার চুলগুলো বব করে দেওয়া হয়েছিল। সালমা ফোলা ফোলা ফাপা চুল নিয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে থাকত।
সালমার বেডের চার-পাঁচ বেড পরে থাকত একটি ছোট ছেলে। মা ছিল ওর সঙ্গে। ওরা ছিল সাঁওতাল। কালো-কুচকুচে গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে ছিল পেটানো শরীর। ওই মাকে দেখতে বেশ লাগত সালমার। সারাদিন তিন বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকত। একটুও ক্লান্ত হতো না। ছেলেটার নেফ্রাইটিস হয়েছিল। হাত-পা চোখ-মুখ সব ফুলো ফুলো। জাপানিদের মতো লাগত। ওই ছেলের আগে আরো সাতটা ছেলেমেয়ে মারা গেছে ওদের। চার বছরের ওপরে কোনোটা বাঁচেনি। সাঁওতাল-মা যখন পাশের রোগীর সঙ্গে গল্প করত সালমা শুনত। মনে মনে বলত, তুমি কেঁদো না সাঁওতাল-মা, তোমার ছেলে ঠিক ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সালমার এমন প্রার্থনা সত্ত্বেও ভালো হয়নি সাঁওতাল ছেলে। দশ দিনের মাথায় ও মরে যায়।
দেয়ালে মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছিল সাঁওতাল-মা। সালমা কেঁদেছিল। ইচ্ছে করছিল সাঁওতাল মাকে জড়িয়ে ধরতে। সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু নিজেই তো নড়তে পারে না। কেমন করে যাবে! সালমা তখন হাতে-পায়ে একটু একটু করে শক্তি ফিরে পাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়তে পারে কেবল। তারপর থেকে কিছুতেই ঘুম আসত না সালমার। আচমকা ঘুম ভেঙে যেত। মনে হতো দেয়ালে কে যেন মাথা ঠুকছে। ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। সালমা চোখ মেলে তাকাতে পারত না। ভয়ে বালিশে মুখ গুজে থাকত। সে মৃত্যুর কথা আজো ভোলেনি ও। স্পষ্ট সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কালো কুচকুচে পেটানো শরীরের একজন সাঁওতাল-মা নিজের শরীরকে তুচ্ছ করে বাচ্চার জন্য কাঁদছিল। সে কী কান্না! কেউ থামাতে পারেনি। এখনো মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে সালমা শুনতে পায় সে ঠকঠক শব্দ।
হাসপাতালের দিনগুলোতে বাবা রোজ যেত। ওকে হাত ধরে হাঁটাবার চেষ্টা করত। ডাক্তার বলেছিল, হাত-পা অনবরত নাড়াচাড়া করতে। সালমা পারত না। দাঁড় করিয়ে দিলে ধুপ করে পড়ে যেত। বাবা কোলে করে উঠিয়ে দিত। আবার দাঁড় করাত।
পাটা সোজা করে ফেল মা। এই তো হয়েছে। বাঃ, লক্ষ্মী মেয়ে। কে বলেছে লিমা পারবে না। আর এক মাসের মধ্যে লিমা পুরোপুরি হাঁটতে পারবে।
বাবা ওকে অনেক সাহস দিলেও ভালোভাবে হাঁটতে এক বছর সময় লেগেছিল সালমার। বার্ম অংশটা অনেকদিন কমজোরি ছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো ওকে। সেইসব দিনে সালমার মনে হতো নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছে ও। ও এক বছর বয়সে যেমন করে হাঁটত তেমনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখছে। হাঁটতে গিয়ে যখন ধপাধপ পড়ে যেত, সেই সাঁওতাল-মার কথা মনে হতো সালমার। মনে মনে বলত, তুমি কেঁদো না সাঁওতাল-মা, আমি নতুন জন্ম নিয়ে তোমার কোলেই ফিরে এসেছি। তুমি কেবল আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। সাঁওতাল-মা তুমি কেঁদো না। অমন করে মাথা খুঁড়ো না।
বাবা অবাক হতো।
কার সঙ্গে কথা বলছে লিমা?
কই? কী যে বলো!
সালমা লজ্জায় চুপ করে যেত।
মাঝে মাঝে বাবা গাড়ি করে ওকে দূরে নিয়ে যেত। হাত ধরে হাঁটত। সাকিব দুষ্টুমি করত। কখনো রাস্তা ধরে সোজা দৌড় দিত, গাছে উঠত। মাঠে নেমে আখ ভাঙত। বাবা ওর দিকে তাকিয়ে হাসত।
কদিন পর তুমি ঠিক অমনি হয়ে যাবে লিমা।
সালমা কথা বলত না। বাবার সান্ত্বনা ওকে তেমন স্পর্শ করত না। মনে হতো, এ জীবনও মন্দ নয়। সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ও একদম নতুন হয়ে উঠছে। এমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়। বাবা ভাবে, সালমা বুঝি মনমরা হয়ে গেছে। বোকা, বাবাটা একদম বোকা। হাসপাতালের দিনগুলো ওর কত যে ভালো লেগেছে ও কি কাউকে তা বোঝাতে পারবে? এই যে নিরিবিলি রাস্তায় চুপচাপ হাঁটা, এই বা মন্দ কী? মাথার ওপর বড় বড় গাছের ছায়া। আম, জারুল, জাম, শিরীষ আরো কত কী গাছ। দু-একটা গাড়ি চলে যায় শব্দ করে। তারপর সব নীরব। বাবা কথা বলে না। সালমা হাঁটতে না পারলে গাছতলায় বসে। বাবা বোতল খুলে পানি দেয়। এক ঢোক পানি, গাছের ছায়া, দূরের মাঠ, ইলেকট্রিক তারে ঝক ঝক শালিক–সব সালমার অন্যরকম লাগে। বাবা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত।
তোমার এখন কেমন লাগছে লিমা?
ভালো।
কী ভাবছ?
একজন সাঁওতাল-মার কথা।
কেন?
জানি না। কেবলই মনে পড়ে। ওর সব বাচ্চা মরে যায় কেন? আল্লাহর এমন ইচ্ছে হয় কেন?
ছিঃ, অমন কথা বলতে নেই।
আমি মরে গেলে কেমন হতো?
দেখো দেখো লিমা, কী সুন্দর পাখি।
বাবা আমি মরে গেলে কেমন হতো?
দেখো লিমা, পাখিটার সারা গা নীল। এ রংটাকে বলে ব্রাইট বু। তুমি না ওইদিন জিজ্ঞেস করেছিলে ব্রাইট বু কোনটা?
বলো না বাবা, আমি মরে গেলে কেমন হতো?
আঃ লিমা!
তুমি কাঁদতে?
আঃ লিমা, এসব কথা মনে করতে নেই।
তুমি কি সাঁওতাল-মার মতো দেয়ালে মাথা ঠুকতে?
তুমি এমন করলে আমি এখান থেকে উঠে একদিকে চলে যাব।
ঠিক আছে, আর কথা বলব না।
দুজনে আবার হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে ফিরে আসত। সাকিবের দুষ্টুমি তখনো শেষ হয় না। সালমা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাকিবকে দেখতে ভালো লাগত সালমার। ওর প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে অনুভব করত। আর তা করলেই ভেতরটা কেঁপে যেত। মনে হতো, ও বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন ভালোর দিকে এগোচ্ছে। না এগিয়ে উপায় কী? বাবা যে ওকে নিয়ে সাধনায় নেমেছে। ভালো করে তুলবার প্রচণ্ড সাধনা। সালমা এসবের কোনো অর্থ খুঁজে পেত না। কেন বাবা এমন করে? না করলেই বা কী?