দিন-রাতের ভাবনা নিয়ে ক্লাসে যায়, লেকচার শোনার চেষ্টা করে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট কোনোরকমে ক্লাসে কাটিয়ে বেরিয়ে আসে। করিডরে গিজগিজ করে ছেলেমেয়ে। রকিবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে ও। তখন হয়তো পরের পিরিয়ডের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। রকিব প্রথম দিকে অবাক হতো। এখন হয় না। জানে সালমা এখন ক্লাস করবে না এবং সঙ্গে সঙ্গে রকিবেরও ক্লাস করা হয় না। দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটে, চারুকলা কলেজের সামনে দিয়ে রেসকোর্সে ঢোকে। নিরিবিলি জায়গা দেখে বসে। কারণে-অকারণে সালমা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
দেখ সালমা অমন করে হাসিস না। তোর হাসি দেখলে রাগ হয়।
নতুন কথা শোনালি। ছেলেরা নাকি মেয়েদের হাসি শুনলে খুশি হয়?
সে তোর মতো মেয়ে না।
তাহলে কার মতো?
ওই যে ঝরনা, মহুয়া ওদের মতো। ওরা মিটমিটিয়ে হাসে, লঘুছন্দে চলে, চকিতে চায়। দেখিস না আমার বন্ধুরা ওদের নিয়ে কবিতা লেখে।
উফ ওদের ভাবভঙ্গি দেখলে আমার কী মনে হয় জানিস?
কী?
মনে হয় বিড়াল মাছ চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছে।
হেসে ওঠে রকিব। সালমা এমনি স্বচ্ছ। অনাবিল স্রোতের মতো। বাতাস কেটে সোজাসুজি চলে। আড়চোখে আশপাশে চায় না। মুখে এক, মনে আর এক নয়। আর এজন্যেই সালমার সঙ্গে রকিবের সখিভাব।
জানিস রকিব, মা মাঝে মাঝে বলে আমি নাকি উচ্ছন্নে যাব। তুই বল নিজের মতো করে কিছু করাকে কি উচ্ছন্নে যাওয়া বলে?
কী জানি। জানি না।
জানিস রকিব, ওই মহুয়াদের মতো চিরকালের মেয়ে হতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে অন্যরকম হতে।
তুই তো অন্যরকমই।
কই আর!
সালমা চুপ করে যায়।
রকিবের মনে হয়, সালমার ভেতরে একটা টেপ রেকর্ডার আছে। ও অনবরত ওখানে শব্দ ধরে রাখে আর বাজায়। ওর মনের মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা কাজ করে। বাবার বিরুদ্ধে বিরাট অভিযোগ পুষে রাখে বুকের মাঝে। বুড়োদের দুচোখে দেখতে পারেনা। বুড়ো বয়সটাকে ভয় পায়। মাঝে মাঝে বলে, জানিস আশি-নব্বই বছরের কথা চিন্তা করলে আমি শিউরে উঠি।
আমার বেশ ভালো লাগে।
যাঃ!
সত্যি বলছি। আমার মনে হয় তখনই তোর সঙ্গে আমার ভালোবাসা গাঢ় হবে।
মিথ্যে কথা! আচ্ছা রকিব, তখন তুই আমাকে চুমু খাবি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়। একশোবার। আরো বেশি করে খাব।
হরিবল!
সালমা ঠোঁট বাঁকায়। দুহাতে মুখ ঢাকে।
ওই বয়সের আগেই আমাকে মরতে হবে।
সালমা কেমন বিষণ্ণ সুরে বলে। ওর মন খারাপ হয়ে যায়। রকিবও আর কথা বাড়ায় না। মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে থেকেও কোথায় যেন উধাও হয়ে যায় সালমা। তখন রকিবের খারাপ লাগে। অন্য সময় ও খুব সপ্রতিভ। ক্লাসের কাউকে পরোয়া করে না। কাছাকাছি বন্ধুদের তুই ছাড়া কথা বলে না। হাসিতে ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখে। কেউ কেউ অপছন্দ করলেও বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে ওকে পছন্দ করে। সালমার বেপরোয়া চলা, অকারণ উচ্ছ্বাস, দমকা হাওয়ার মতো আচরণ ইত্যাকার গুণাবলি ওকে বেশ জনপ্রিয় করেছে। বন্ধুরা বলে, সালমা যখন যেমন খুশি তখন তেমন। যখন তখন হুঁস করে ইঞ্জিনের গা ছেড়ে বেরিয়ে আসা ধোয়ার মতো নিমেষে ভেসে যায়। সেখানে থৈ পাওয়া দুঃসাধ্য।
সেই গরমের দুপুরে বাবার বিরুদ্ধে ভাবতে ভাবতে চিন্তায় বাবাকেই আঁকড়ে ধরে সালমা। বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখে আসছে সালমার প্রতি তার কী টান! সাকিবের জন্য বাবা এমন করে না। অথচ সালমা ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। সালমা হবার পর বাবার নাকি চাকরিতে উন্নতি হয়েছিল। প্রচণ্ডভাবে ভাগ্যে বিশ্বাসী বাবাকে গণক বলেছিল, এ মেয়ে আপনার জন্য ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে। ও যেদিন ঘর ছাড়বে তারপরই আপনার একটা অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
বাবা কি ভাবে, সালমার ভাগ্যটা বাবার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা, এজন্যেই ওকে বাবার প্রয়োজন? বুকটা কেমন করে। না ভাবলেই ভালো। সুখের স্মৃতি কিছু ভাবতে চাইল ও। সেই পনেরো বছর বয়সে যখন একবার পোলিও হয়েছিল তখন বাবা একমুহূর্ত ওকে ছেড়ে কোথাও যেত না। কোলে করে এঘর-ওঘর করত। মাঝে মাঝে সালমা ব্যথায় কাঁদত। মনে হতো সালমার যন্ত্রণাটা বুঝি তার নিজের শরীরেই ছেয়ে গেছে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত অবশ হয়ে গিয়েছিল। সালমার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসকরত। কথা বেরোতে চাইত না। কোনোদিকে নড়াচড়া করতে পারত না সালমা। বাবা উৎসুক চোখে ওর। দিকে চেয়ে থাকত। রাতে কাছে নিয়ে ঘুমোত। সালমা কোনোকিছুই ভাবতে পারত না। ভাবতে গেলে মৃত্যুর কথা মনে হতো। আর তখনই কান্না পেত।
তিনদিন বাড়িতে থাকার পর ডাক্তারের পরামর্শে বাবা ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাসপাতাল। দোতলা ঘরে কোণের দিকে ছিল ওর বিছানা। জানালা দিয়ে নিচের জারুল ফুলের গাছ দেখা যেত। সাদা আর বেগুনি থােকা ফুলে ছেয়ে থাকত গাছটা। সালমার ভীষণ ভালো লাগত। ওই গাছ আর মিনু বউদি এখনো হাসপাতালের স্মৃতি হয়ে আছে। বউদি ওকে খুব আদর করত। একজন নার্সের কাছে রোগী হিসেবে যেটুকু সেবা প্রাপ্য ছিল তার বেশি পেত মিনু বউদির কাছে। যেজন্যে হাসপাতাল ওর খারাপ লাগেনি। ওষুধের গন্ধ, ইনজেকশন, স্যালাইন, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি বাজে ব্যাপারগুলো মিনু বউদি ওকে একদম সহজ করে দিয়েছিল। সে কারণে ওষুধ খেতে সালমা কখনো আপত্তি করেনি। সে যত তেতো ওষুধই হোক।
সেটা ছিল জুলাই মাস। যখন তখন ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি আসত। জারুল ফুল গাছটাকে মনে হতো যেন গা পেতে দিয়ে নরম সোহাগ নিচ্ছে। একটা-দুটো পাপড়ি ঝরে যেত। সালমা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকত। বাগানজুড়ে কত ফুলগাছ ছিল। কোনো গাছ এমন করে ওকে টানেনি।