আবুল হাশেম জোরসে বিড়িতে টান দেয়। উঠোনে বেলগাছের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় আঁকাবাঁকা সুন্দর একটা ছবি ফুটে উঠেছে উঠোনের ওপর। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছবিটা রাহানুম হয়ে যায় আবুল হাশেমের দৃষ্টির সামনে। এমন একটা ছবি সেদিন জ্ঞান ফেরার পর আবুল হাশেম দেখেছিল। ওর পাশেই এমন ছবির মতো পড়েছিল রাহানুম। ও কোন এলাকা থেকে ভেসে এসেছিল আবুল হাশেম জানে না। চুলগুলো মুখের ওপর লেপ্টে ছিল। নগ্ন শরীর। আবুল হাশেম চমকে উঠে আত্মস্থ হয়ে দেখেছিল, ও এক তীক্ষধার যুবতী। নিঃসাড়, নিস্পন্দ শরীর। কাছে-ধারে কেউ আর কোথাও নেই। সাগর শান্ত, কোনো ঝড় নেই, বাতাস নেই, বৃষ্টির ফোঁটা নেই, মেঘ নেই। ও ভেবেছিল এমন। শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝেই জীবন শুরু হয়।
ও উঠে হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পায় ঘর-সংসারের অনেক ছোটখাটো জিনিস বালুর মধ্যে গেঁথে আছে। ও একটা শাড়ি কুড়িয়ে এনে ঢেকে দেয় রাহনুমকে। ভেবেছে, ও মৃত। চারদিকে মানুষজন উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। কে মৃত, কে জ্ঞান-হারানো বোঝা যায় না। তবে ও কেন রাহামের জন্য মমতা বোধ করল? ও যদি মরেই থাকে তবে কিসের লজ্জা? লজ্জা ঢাকারই বা দরকার কী? এত এক কঠিন সময়–চারদিকে বিপর্যস্ত জীবন। এ জীবনে হাহাকার, ক্রন্দন–তবু সবকিছু ছাড়িয়ে মানুষের জন্য মানুষের মমতা। মানুষইতো পারে মানুষের লজ্জা ঢেকে দিয়ে তাকে বড়ো করে তুলতে। ও শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া রাহালুমের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়। আসলে রাহানুম উপলক্ষ মাত্র, ওর বুকের ভেতর তীব্রভাবে গেঁথে আছে মণিমালা। ওর ব্যাকুল দৃষ্টি মণিমালাকে খুঁজছে। ও কোনোকিছু অবলম্বন করে মণিমালার শোক সামলাতে চাইছে, নিজেকে শক্ত করতে চাইছে। কিন্তু পারছে কই? চারদিকে তাকিয়ে অনুভব করতে চায় যে মণিমালা কি কোথাও এমন উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে? শকুনে খুবলে খাচ্ছে মণিমালাকে? না কি ওর মতো কেউ ঢেকে দিচ্ছে মণিমালার লজ্জা? ভাবতেই ড়ুকরে কেঁদে ওঠে ও।
অনেকক্ষণ হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শান্ত হয়। সাগরের গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এ বেলাভূমিতে। কোথাও পাখির ডাকও নেই। ও আকাশের দিকে তাকায়, ঝকঝকে নীল আকাশ, পরিষ্কার দিন। ওর বুক ভেঙে আসে, হাঁটু ভেঙে আসে। খিদেয় ওর পেট জ্বলে, পিপাসায় বুক শুকিয়ে যায়। তারপরও যতটুকু শক্তি ও প্রাণপণ চেষ্টায় যতদূর যেতে পারে ততদূর গিয়ে মণিমালাকে খোঁজে, ছেলেমেয়েদের খোঁজে, না কেউ কোথাও নেই, কারো কোনো চিহ্নও নেই–ওদের কারো একটি জামা, একটি লুঙ্গি অথবা একটি মৃত গরু কিংবা খোয়াড়ের সবচেয়ে বড়ো হাঁসটি। নিজের ভুল হতে পারে ভেবে যারা উপুড় হয়ে আছে তাদের উল্টে দেখে। হতাশ হয়, ক্লান্ত হয়। বুকে হাঁফ ধরে। বুক চেপে গেলে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ও একটু একটু করে ডাঙার দিকে এগোয়। গাছের ডালে আটকে আছে মানুষ, ঝুলছে। হাত ছড়িয়ে আছে দুদিকে, পায়ে বিশাল ক্ষত। ভয়ে শিউরে ওঠে আবুল হাশেম। দ্রুত চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কতবার চোখ বন্ধ করবে ও? সামনেই খেজুর কাঁটায় বিধে আছে তিনটে শিশু–যেন কোচ দিয়ে গেঁথে তোলা মাছ। আরো দৃশ্য আছে–বীভৎস, ভয়াবহ। কিন্তু এইসব দৃশ্য আবুল হাশেম দেখতে চায় না, ওর হৃদয় পীড়িত হয়–পীড়িত হয়ে জ্বলতে থাকে এবং ওর ভেতরে আর একটি জলোচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে–সে বেড়ে ওঠায় গড়াতে থাকে ওর মনোভূমি, ওলটপালট হয়ে যায়–ও বদলাতে থাকে, যেমন বদলায় সাপের খোলস।
আবুল হাশেম নিজেকে নিজের ভেতর ধরে রাখতে পারে না। টের পায় ক্ষয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে পুরনো আবুল হাশেম। ও আবার সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে। ও বুঝতে পারে না যে ও কোথায় এসেছে। এখন ও পুবে যাবে না পশ্চিমে? পুবে আছে কি ও বাড়ি-ঘর? না কি পশ্চিমে? একটি ভাঙা ট্রলারের ওপর ও এসে বসে।মাথা কেমন করছে। ট্রলারের গায়ে হেলান দেয়। দেখতে পায় জোয়ার আসছে।
এক সময়ে এই দিন ফুরিয়ে যাবে, রাত আসবে। তখন? না, ভয় পায় না ও। সেইসব দৃশ্যগুলো ওকে এখন আর ভীত করে রাখছে না। ও এইসব দৃশ্য বাস্তব বলে ধরে নিয়েছে। বোঝে বুকের ভেতর ভয়ের কিছু নেই। বুকের ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়া ওর ভয় রোধ করেছে। ও ভাঙা ট্রলারে বসে থেকে পাখির ডাক শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু না, দু’চারজন মানুষের আর্তনাদ ওর কান ভরে দেয়। এতক্ষণে ও খেয়াল করেনি যে যারা বালুর মধ্যে উপুড় হয়ে চিৎ হয়ে পড়েছিল তারা কেউ কেউ নড়েচড়ে উঠছে–তারা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। এতক্ষণ ওরা মুমূর্ষ ছিল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে ওরা আর্তনাদ করছে। ওহ কী নিদারুণ সেই শব্দ। এতক্ষণ ও শব্দ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু সে তো এমন ভয়াবহ শব্দ নয়। যে শব্দ আনন্দের নয়–সান্ত্বনার নয়–অনুপ্রেরণার নয় সে শব্দ ওকে নিষ্পেষণ করতে থাকে। শব্দ যেন আকাশ-পাতাল ফুড়ে বেরিয়ে আসছে। মানুষের হৃদয়ে কি এমন হাহাকার জমে থাকে? আগে কখনো। তো এমন শব্দ শোনেনি আবুল হাশেম। বিলাপ শুনতে শুনতে ওর শরীর অবশ হয়ে গেলে ও আবার জ্ঞান হারায়। চোখের সামনে বিলুপ্ত হয় এক সকালের এই পরিচিত জায়গাটি।
বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পায় ওর পায়ের কাছে রাহানুম, গুটিসুটি বসে আছে–আলুথালু চুল–উদ্ভ্রান্ত চাউনি। আবুল হাশেম ধড়মড়িয়ে উঠে বসে, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। রাহানুম কেন ওর কাছে এসে বসে আছে তা ও বুঝতে পারে না। যে শাড়িটি কুড়িয়ে এনে আবুল হাশেম ওকে মৃত মনে করে ঢেকে দিয়েছিল সেই শাড়িটি পরে আছে। ও কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না। যদিও আবুল হাশেমের নিজের খুব অবসন্ন লাগছিল, তবুও ওর চেতনা ছিল প্রখর। কিন্তু রাহানুমকে দেখে ওর মনে হচ্ছিল ও সুস্থ নয়, অপ্রকৃতিস্থ। ও মৃদু স্বরে ডাকে, মা, মাগো?