আজফারের কথা শুনে আবুল হাশেমের চৈতন্যে কেয়ামত শব্দ তোলপাড় করে ওঠে। তাইতো, কেয়ামত কি এমন? এমন ভয়াবহ, এমন সর্বগ্রাসী! সেদিন কি এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে? না, বিশ্বাসতো এমন যে সেদিন মাথার এক হাত ওপরে সূর্য নেমে আসবে। তাহলে? তাহলে কেয়ামত কেমন?
শুনতে পায় ঘরের ভেতর মণিমালা চিৎকার করে কাঁদছে। দরুদ পড়ছে। ও দ্রুতপায়ে ঘরে ঢোকে। বুঝতে পারে মণিমালা ছোট মেয়ে দুটোকে কোলের মধ্যে নিয়ে চৌকির ওপর বসে আছে। আবুল হাশেম আযান দেয়।
আশেপাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন দৌড়ে এসে উঠেছে ওদের বারান্দায়। ওদের গায়ে ভিজে কাপড় সপসপ করছে। ওদের ব্যাকুল প্রশ্ন, কি অইবে মিয়াবাই?
আল্লার নাম ল।
আবুল হাশেমের গলা কেঁপে যায়। আজফার তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, সাগর ফুইলা উঠছে। আল্লার নাম লইলে কি বাঁচন যায়?
মৃত্যুচিন্তায় হতবিহ্বল মানুষগুলো হাহাকার করে ওঠে। কপাল চাপড়ায়। এমন সর্বনাশ ওরা আগে কখনো দেখেনি বলে বিলাপ করে। ততক্ষণে উঠোনে জমে ওঠে ভিড়–আরো নারী-পুরুষ ছুটে এসেছে আশ্রয়ের আশায়। আবুল হাশেম আযান দিতেই থাকে। চিৎকার করতে করতে ওর গলা ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের কোলাহল এবং আর্তনাদ। আর সময় নেই। প্রবল বেগে ছুটে আসছে জলোচ্ছ্বাস। কানের তালু ফেটে যেতে চায় সেই শব্দে।
ওহ খোদা!
ঘরের ভেতর মণিমালা আবার আর্তনাদ করে, যে কণ্ঠ নীরব হয়ে গিয়েছিল সে কণ্ঠে এখন মরণধ্বনি–ও ছুটে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছোট মেয়েটি কোলে, বড়োটি মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। আবুল হাশেম মণিমালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
মণিমালা দু’হাত দিয়ে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরে, এই জনমে আপনের লগে আর দেহা অইবো না।
আবুল হাশেমের বুক কেঁপে ওঠে। শরীরও কাঁপে থরথর করে। স্ত্রীকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না। স্ত্রীর হাত জড়িয়ে ধরেই বলে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।
তারপর এক গভীর হিমশীতল স্পর্শে ভেসে যায় চরাচর। কে কোথায় চলে যায় আবুল হাশেম তা আর জানে না। মণিমালা শক্ত মুঠিতে চেপে রেখেছিল। কেমন করে বিচ্ছিন্ন হলো ওরা? আবুল হাশেম জানে না। জানার কথা চিন্তা করতে চাইলেই ওর মগজে একটি শব্দ স্থির হয়ে থাকে, কেয়ামত। সে রাতকে ও কেয়ামত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ও কাউকে খুঁজে পায়নি। সাগর ওদের কতদূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? কোনো নতুন চরে রেখে এসেছে ওদের লাশ? সে লাশ কি শকুনে খেয়েছে? ভাবলে বুকের ব্যথা তীব্র হয়–একজন মানুষকেও খুঁজে পেল না ও। এমন সাজানো-গোছানো সংসার ভেসে সাফ হয়ে গেল। ভিটে ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অস্থির হয়ে ওঠা গরুগুলোও কোথায় যে ভেসে গেল? কিন্তু খুঁজে পেল ভিন্ন দুজন মানুষ–একজন রাহানুম। অন্যজনের নাম ওরা জানত না। রাহানুম নাম রাখল সুখদীপ।
ওদের না পেলে হয়তো অন্যরকম হতো জীবন। হয়তো পাগল হয়ে যেত। পথে পথে ঘুরে বেড়াত–ন্যাংটো, নোংরা খুঁটে-খাওয়া হয়ে যেত এতদিন। যেমন মতি পাগলা ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে, বাজারে। ভাবলে শিউরে ওঠে শরীর। ওহ্ বেঁচে থাকার ওই পতন থেকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রাহানুম আর সুখদীপ। ওদের পেয়ে ও একটা দায়িত্ব পেয়েছে, দায়িত্ব পেয়ে ওর কাজ বেড়েছে। কাজ ওর শোক কমিয়েছে। তাই ওর হৃদয় শান্ত হয়েছে, স্থিত হয়েছে। ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার যোগ্যতা ফিরে পেয়েছে। ও রাহানুম আর সুখদীপের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। বোঝে মানুষই পারে মানুষকে মানুষ রাখতে।
মাঝে মাঝে রাহানুম বলে, বাবা আমনেরে না পাইলে মোগ কি অইতো? মোরা কই যাইতাম? সুখদীপ ওই সাগরের ধারে মইরা থাকত। আর মুই ভিখ করতাম।
আবুল হাশেম গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমারে মুই বাঁচাইছিলাম, আর সুখদীপরে তুমি। আর সুখদীপ আমাগো দুইজনরে বাঁচায়ে দিছে। নইলে মোরা পাগল হইয়া যাইতাম।
রাহামের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার ভারে চকচক করে ওঠে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, হ ঠিক। আমরা হকলে হক্কলের লাইগা। হলে সমান।
আবুল হাশেম অনেক ভেবেছে, প্রয়োজন কি বন্ধন টিকিয়ে রাখে? তাহলে ওরা কি আমৃত্যু এভাবে দিন কাটাতে পারবে? কেউ কাউকে কখনো ছেড়ে যাবে না? ভাবতে ভাবতে ওর একটা বিড়ি ফুরিয়ে যায়। ও সেই আগুন থেকে আর একটা বিড়ি ধরায়। তখন রাহানুম বাসনকোসন গুছিয়ে রেখে কাছে এসে দাঁড়ায়, বাবো স্বরে লন? ঘুমাইবেন না?
ঘরে গরম লাগে। এহানে থাহি। তুমি ঘুমাও।
রাহানুম চলে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে। একটু পরে নিভে যায় কুপির আলো। চারদিক সুনসান। আবুল হাশেমের কানে অস্পষ্ট গোঙানির ধ্বনি ভেসে আসে। আবুল হাশেম জানে এই মুহূর্তে ওই শব্দের। কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। ওটা চৈতন্যের ভেতরের শব্দ। ও ভাবনা ঘুরিয়ে নেয়। বুঝতে পারে রাহানুম শুয়ে পড়েছে। একটু পর ওর ঘুম গাঢ় হয়ে যাবে। এই শব্দময় পৃথিবী থেকে ও দূরে চলে যাবে। কেমন করে শুয়েছে রাহনুম? চিৎ হয়ে না কাৎ হয়ে? নাকি উপুড় হয়ে? নিঃশ্বাসে ওর বুক উঠছে আর নামছে। অন্ধকারে ওর চোখের পাতা স্তব্ধ। সেদিনও বালুর ওপর চোখ বুজে পড়েছিল রাহানুম। না, সেটা ঘুমুনোর জন্য শুয়ে থাকা ছিল না। ঘুমুনোর ভঙ্গি অমন হয় না। ক্ষীণ নিঃশ্বাসের কারণে ওর কোনো স্পন্দন বোঝা যাচ্ছিল না। ও ছিল মৃতবৎ। শুয়ে থাকার যে ভঙ্গি নিপ্রাণ থাকে, সেখানে ভঙ্গিটা প্রধান হয় না। প্রধান হয় বাস্তববোধ, তার কার্যকারিতা। সেদিন রাহনুমের শরীর সবটুকু কার্যকারিতা হারিয়েছিল।