বাবো, আর এক চামুচ ভাত দিমু?
আবুল হাশেম রাহামের কণ্ঠ শুনতে পায় না। তখন তো চরের মধ্যে কেবল আর্তনাদ ছিল–ছিল মানুষের আহাজারি। কোনো পাখির ডাক না, পানির কলকল না–প্রচণ্ড এক ভৌতিক নিস্তব্ধতা অকস্মাৎ মানুষের সব আর্তনাদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সবাই–স্বজন হারানোর বেদনা বরফের মতো জমাট হয়ে ছিল। ওহ্ সেই কটা দিন! সেই কটা দিন! আবুল হাশেমের কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি। চোখ গোলাকার বর্তুল, অথচ বিস্ফারিত। আদিম গুহা থেকে বেরিয়ে আসা বুনো জন্তুর মতো হয়ে যায় আবুল হাশেম।
রাহানুম বিস্মিত হয়ে ডাকে, বাবো, ও বাবো? কি অইছে?
রাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আবুল হাশেম। সেই মুখটা বালুর ওপর আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে যায়, যে রেখাগুলো অজস্র কাঁকড়ার চলে যাওয়ার পদচিহ্ন। তখন ওর কেউ ছিল না, কেউ না। স্ত্রী, ছয় ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, কেউ না। বিরাট প্রান্ত র ছিল ওর জন্য উন্মুক্ত, ও ছিল সেই প্রান্তরের অধীশ্বর–তারপর থেকে খোলা প্রান্তরে একা একা ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যেস হয়ে গেল। হা-হা করে হেসে উঠতে চায় ও। কিন্তু পরক্ষণে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহানুমের মুখের দিকে। ওর খাওয়া শেষ। ও এখন হাত দেবে। রাহানুম পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আবুল হাশেম সানকি ভরে পানি ঢালে তারপর সেখানে হাত ডোবায়। ধুয়ে যায় ডাল, তরকারির ঝোল, ভাতের চিহ্ন।
ও নিঃশব্দে উঠে আসে। বারান্দার হোগলার ওপর বসে বিড়ি ধরায়। শুনতে পায় সুখদীপ হাসছে। রাহানুম ওকে ধমকাচ্ছে। হাসতে নিষেধ করছে। বলছে, বেশি হাসি ভালো না। রাহামের এই এক অভ্যেস। হাসি শুনলে ও ভয় পায়। মনে করে হাসলেই সামনে বিপদ। আবুল হাশেম বিড়বিড়িয়ে বলে, জানি না, জানি। ক্যান হাসি শুনলে তোর এমন লাগে। কিন্তু সুখদীপের এখন হাসার বয়স, ও হাসবেই। শৈশবেইতো মানুষ না বুঝে হাসে, তারপর কি আর পারে? কিন্তু না, এটা বোধহয় সত্যি নয়, সেই খোলা প্রান্তরে একা হয়ে যাবার পর তো আবুল হাশেম অকারণেও হাসতে শিখেছে। তখনতো ওর শৈশব ছিল না। কৈশোরও। একেবারে ভরা মধ্যবয়স। সেই যে শুরু। এখনো হা-হা করে হাসলে বুকটা খোলা প্রান্তরে ছুটে যাওয়া বাতাসের মতো শোঁ-শোঁ শব্দময় হয়ে যায়। তখন রঙিন মাছ ভেসে আসে, বুদ্বুদ ওঠে, গাছের পাতারা সবুজ হয়, জংলাভূমির ঝরা পাতাগুলো পায়ের নিচে মচমচ করে। নাকের কাছে বুনোফুলের গন্ধ তীব্র হয়। গভীর সমুদ্রে গেলে গাঙচিলেরা ট্রলারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ওদের ছায়া পড়ে শরীরে। চারদিকের অথৈ নীলে সেই শব্দময় হাসির থৈ-থৈ নৃত্য কলকল শব্দে বয়।
এক সময়ে ও অনুভব করে সুখদীপের হাসি আর নেই। ও খেয়েদেয়ে শুয়েছে। রাহানুম খাচ্ছে, নয়তো বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে। তারপর একবার ওর কাছে আসবে। বলবে, বাবো, ঘুমাইবেন না? এমন পূর্ণিমা রাতে আবুল হাশেমের ঘুম আসে না, আসতে চায় না। আর যদি আসেই তবে আবুল হাশেম এই বারান্দায় হোগলার ওপর ঘুমিয়ে যাবে। কোনো কিছু তখন ওর আর মনে থাকবে না। দু’চোখ জুড়ে ঘনিয়ে থাকবে অন্ধকার। পৃর্ণিমার বিপরীতে যে অন্ধকার থাকে তার নামইতো অমাবস্যা। অমাবস্যা ও সহ্য করতে পারে না। এইতো ক’বছর আগে অমাবস্যার রাতে সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। কী ভীষণ অন্ধকার ছিল সেদিন।
সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। গোয়ালে গরুগুলো চাড়িতে মুখ দেয়নি। ব্যাকুল স্বরে ডেকেছিল কেবল। ঘরে-বাইরে ছুটোছুটি করেছিল আবুল হাশেমের পঞ্চান্ন বছরের স্ত্রী মণিমালা। ওর বাবার এক পীর সাহেব এই নাম রেখেছিল। পীর সাহেব ওর বাবাকে বলেছিলেন, মাইয়া যা কয় হুনবেন। মাইয়ার মধ্যে জ্যোতি আছে।
জ্যোতি নয়, মণিমালার ছিল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সুখ-দুঃখের অনেক কিছুই আগে থেকে আঁচ করতে পারত। আবুল হাশেমের কাছে এসে বারবার বলছিল, আইজ একডা কিছু ঘটবে।
মার ক্যাবল অলুক্ষণে কতা।
চেঁচিয়ে ওঠে বড়ো ছেলে আজফার। আবুল হাশেমের বুক ভয়ে কাঁপে। ও চেনে ওর স্ত্রীকে, বিশ্বাসও করে। মণিমালা যখন বলছে তখন একটা কিছু ঘটবেই।
রাত যত বাড়ে, ঝড়ের দাপট বাড়ে। বাতাসে নারকেল গাছের মাথা ভেঙে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দু’হাত দূরের কিছুই চোখে পড়ে না। কনকনে বাতাসের জোর ঝাপটা এসে চামড়া ফাটিয়ে দিয়ে যায় যেন। চিনচিন করে ওঠে গাল-ঠোঁট। মণিমালা আজফারকে ডেকে বলে, গরুগুলোর বাঁধন খুইল্যা দে। হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় খুইল্যা দে।
আজফার দৌড়ে উঠোনে নামে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের জোর ধাক্কা বাড়ছে। বৃষ্টির সূঁচালো ফোঁটা তীরের মতো ঢুকে যায় শরীরে। গোয়ালে ও স্থির দাঁড়াতে পারে না। বাতাস ওকে উড়িয়ে নিতে চায়। একবার এদিকে একবার ওদিকে পড়ে যেতে চায়। কখনো বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। অন্ধকারে গরুর দড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। অস্থির গরুগুলো লাথি দিচ্ছে। বারান্দা থেকে বাবা ওকে ডাকছে। নিরুপায় ব্যর্থতায় আজফার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। একটি গরুর দড়িও খুলতে পারে না আজফার। আবুল হাশেমের ব্যাকুল কণ্ঠ বাতাস ছিড়েখুঁড়ে ওর কাছে ছুটে আসে, ও বাবা তুই ঘরে আয়, ও বাবা আজফার। শোনা যায় মণিমালারও কণ্ঠ। দুজনেই ব্যাকুল হয়ে ওকে ডাকছে। আজফার গরু রেখে দৌড়ে ঘরে ফেরে। তখন ওর বুক ফেটে যায়। ও বুঝতে পারে খুঁটি উপড়ে না গেলে গরুগুলো বাঁধা অবস্থায় মরে যাবে। খুঁটি খুলে দিতে পারলে গরুগুলো ভাসতে ভাসতে কোথাও না কোথাও গিয়ে হয়তো বেঁচে যেতে পারত, নাও পারত। কিন্তু এখনতো ওই গোয়াল ঘরে ওগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত। ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গেলে ও একটা সুরাও পড়তে পারে না। ব্যাকুল হয়ে শক্ত হাতে বারান্দার খুঁটি চেপে ধরে। তখন শুনতে পায় প্রবল গর্জনে এগিয়ে আসছে সমুদ্র। আকাশে চাঁদ নেই। আকাশে ঘন কালো মেঘ–অন্ধকারে তা দেখা যায় না। একসময়ে আজফার চিৎকার করে ওঠে, বাবো, কেয়ামত, কেয়ামত। আইজ কেয়ামতের রাইত বাবা।