হো-হহা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম, যেন জীবনের এমন মজা ও আর কখনো পায়নি।
রাহানুম হাসে না। ওর রাগ হয়। সুখদীপকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ও দপদপিয়ে ঘরে চলে যায়। ঘরে কুপি জ্বালানো ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে খোলা দরজা দিয়ে আবুল হাশেম দেখতে পায় ঘরে কুপির শিখা কাঁপছে। একটু পর কুপির শিখা আড়াল করে দাঁড়ায় রাহানুম। ওকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয়–সমুদ্র ক্ষেপে গেল যে ঢেউ উন্মত্তের মতো ছুটে আসে, ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায় পুরো জনপদ। চিহ্ন থাকে না বাড়িঘর, ছোট গাছ কিংবা মানুষের। রাহানুম ভাতের হাঁড়ি, বাসনকোসন নাড়াচাড়া করছে। টুংটাং শব্দ আসছে কখনো কখনো। এখন খেতে হবে, ঘুমুতে হবে, একটি পুরা রাত্রি পার করতে হবে। ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যু না ঘটে গেলে কিংবা প্রবল জলোচ্ছ্বাস তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে সাগর থেকে ছুটে না এলে, কোনো তোলপাড়ে সবকিছু তছনছ না হয়ে গেলে আবুল হাশেমের জীবনে আর একটি দিনের সূর্য উঠবে। ভাবতে ভাবতে ও সুখদীপকে নিয়ে পুকুরের পাড়ে আসে। সুখদীপ দৌড়ে ঘাটলায় নামে। ঝপঝপিয়ে মুখে পানি দেয়। ভিজে যায় গলা, বুক। অল্পক্ষণ পানি নিয়ে মাতামাতি করে ও। দু’হাতে পানি নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তারপর এক দৌড়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে ওঠে।
আবুল হাশেমের মনে হয় ও একটা উড়ুক্কু মাছ। এই গতি বোধহয় শৈশবেই থাকে, যত দিন যায় গতি কমতে থাকে। আবুল হাশেমের এই বয়সে কোথাও গতি নেই। ওর গতি এখন স্বপ্নে। ওর জীবনে এখন এক উজ্জ্বল স্বপ্নের সময়। স্বপ্নের ভেতরে ও দ্রুতবেগে মাইল মাইল পথ হেঁটে যায়–দুরন্ত গতিতে ট্রলার ছোটায়। ক্লান্তিহীন। ক্ষান্তিহীন।
ও পুকুরের ঘাটলায় বসে দুহাতে পা পরিষ্কার করে। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বালু জমে আছে। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত সৈকতের বালু উঠে এসেছে। বালু তাড়াতে ও বড়ো বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ে। শরীর শিরশির করছে। মনে হয় যেন জিভের নিচেও বালুর পরত জমেছে। ওর মগ্ন চৈতন্যে একটা ডাক ভেসে আসে। ও উপেক্ষা করে। এখন কোনো ডাক শুনতে চায় না। তবু শব্দটা ওর ভেতরে প্রবেশ করে। ও বুঝতে পারে রাহানুম বারান্দা থেকে বাবা, বাবা করে চিৎকার করছে। স্থবির হয়ে আসে আবুল হাশেমের শরীর। ও কি রাহামের বাবা? কেমন করে? যে পদ্ধতিতে একজন মানুষ আর একজন মানুষের বাবা হয় সে পদ্ধতিতে ওর এবং রাহানুমের জীবনে অনুপস্থিত। ওর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, আমি বাবা নই। আমার কেউ নেই। কিন্তু ওর গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। ও বোঝে ওর কোনো কিছু বলা হবে না। জীবনটা এমন–এমন জটিল সম্পর্কে নিগড়ে বাঁধা–এর থেকে মুক্তি নেই। আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই চেঁচাতে পারে না। এমন করেই মেনে নিতে হয় বন্দিত্ব। নিজের কাছ থেকে কোথাও কি পালানোর উপায় আছে? পানির ভেতর আবুল হাশেমের দু’হাত থেমে থাকে। মনে হয় পানির স্পর্শও সুখকর নয়–তা জটিল এবং যন্ত্রণাকর।
এক সময়ে রাহালুমের কণ্ঠ তীব্র হয়ে ওঠে। ও চেঁচিয়ে ডাকছে। হয়তো ভেবেছে যে আবুল হাশেম শুনতে পাচ্ছে না। হয়তো আবুল হাশেম বধির হয়ে গেছে। যেমন বধির হয়ে গিয়েছিল সেই প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের পর–যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল শরীরের যাবতীয় শিরা-উপশিরা–বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল মগজ এবং দু’চোখ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল স্বপ্ন। আজ আবুল হাশেমের জীবনে আবার স্বপ্ন উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু সে স্বপ্ন শুধুই মগজের–ধুলোমাটির নয়–যে ধুলোমাটির মধ্যে প্রতিদিনের জীবন বাড়তে থাকে। আবুল হাশেম দ্রুত হাত পা প্রক্ষালন করে। লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে ওঠানো। দু’হাতে মুখে পানি ছিটায়। ঊরু ভিজে যায়। নাকের ভেতর পানি যায়। চোখ জ্বালা করে। মিঠে পানির স্পর্শ, তবু আবুল হাশেমের চামড়ায় সে স্পর্শে নোনা স্পর্শ। ও কিছুতেই নোনা-স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না যেন নাকের পাশ দিয়ে খলখলিয়ে বয়ে যাচ্ছে নোনা পানির স্রোত–মাথার ওপর দিয়ে–পায়ের নিচেও–নোনা জল স্পর্শ করে ভূমি–নষ্ট হয়ে যায় ভূমির উর্বরতা। আবুল হাশেম এখন তেমন এক পতিত জমি–যে জমির ফসল নষ্ট করেছে সাগরের লবণাক্ততা। ও ঘাটলা থেকে উঠে আসে। একগুচ্ছ ঘাসে পা মুছে নেয় এবং ঘাড় নিচু করে লুঙিতে মুখ মোছে। ওর। শরীরে জলের চিহ্ন রাখতে চায় না। কিন্তু মুছবে কী করে? নোনা জলতো ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে জীবনের সব ফসল।
আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে ঘরে আসে। সুখদীপের সানকিতে বড়ো একটা মাছ। ও মাছের কাঁটা বাছে। ফকফকে সাদা ভাত লাল সানকিটায়–আবুল হাশেম অন্ধের মতো তাকায়। ভাতকে ভাত মনে হয় না। ওগুলো কি কাঁকড়ার গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চা? লুঙ্গি দিয়ে হেঁকে তুললে হাজার হাজার উঠে আসে। ও হোগলার ওপর বসে নিজের সানকি টেনে নেয়। এক নিমগ্ন ঘোরে ও ভাত খেতে থাকে–পেট ভরে ভাত খায়।
রাহানুম ওর থালায় মাছ তুলে দেয়, শাক ভাজি দেয়, খেসারির ডাল দেয়, তিন-চার চামচ ভাত বেশি দেয়–তবু আবুল হাশেম না করে না। খেতেই থাকে। সুখদীপ এবং রাহানুম যে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় সেটা ও খেয়াল করে না। ওর কেবলই মনে হয় ও যেন কতকাল খায়নি। সেই জলোচ্ছ্বাসের পর প্রচণ্ড খিদে নিয়ে অনবরত দৌড়ে বেড়াত চরের মধ্যে। কোথাও কোনো খাবার ছিল না। তীব্র বিবমিষায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে ও দু’হাতে পেট চেপে মাটিতে গড়াত। ভিজে মাটিতে মাখামাখি শরীর–কী অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছিল কটা দিন।