আবুল হাশেমও দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ খানিকটা দূর থেকে রাহাম এগিয়ে আসছে। যত এগিয়ে আসছে আবুল হাশেমের চোখে ও তত অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেন এমন হয়? কেন মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকে সবকিছু মুছে যেতে থাকে, জেগে ওঠে ভিন্ন অবয়ব–যার কাছে আবুল হাশেম কিছুতেই যেতে পারে না–তখন সেই রঙিন মাছটা আবুল হাশেমের মগজ আলোকিত করে দেয়। সেই আলোকিত মুহূর্তে রাহানুম আবুল হাশেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে, কি রে তোর হারাদিন খাডনি গেছে? আঁটতে খারাপ লাগছে মা?
না বাবো, না, আইজগো পুন্নিমা খুব সুন্দর। জানো বাবো, এত বড় গোল চান মুই আর দেহি নাই।
এইডা দেইখ্যা মুই পাগল অইয়া যাই।
আবুল হাশেম হা-হা করে হাসে। হাসি ছড়িয়ে যায় খোলা প্রান্তরে। দমকে দমকে হাসির রেশ বাড়তে থাকে। হাসতে থাকে রাহানুম এবং সুখদীপও। ওরা খানিকটা অবাক হয়ে আবুল হাশেমের এই প্রবল হাসি শোনে। ওরা বুঝতে পারে না যে আবুল হাশেম নিজেকে মেলে দিতে চাইছে এই খোলা প্রান্তরে। ও চায় যতদূর চোখে দেখা যায় ততদূর ছড়িয়ে যাক ওর হাসি–কিংবা যেটুকু চোখে দেখা যায় না, সেখানেও পৌঁছে যাক ওর হাসি।
একসময় সুখদীপ আবুল হাশেমের হাত ধরে টান দিয়ে বলে, এইর লাইগ্যা তো মানে আমনহেরে পাগলা বুড়া কয়।
আবুল হাশেমের যে হাসি প্রায় থেমে এসেছিল সেটা আবার প্রবল হয়ে ওঠে–হাসির তোড়ে হেঁচকি ওঠে ওর। আসলে ঠিক হেঁচকি নয়, একটা টান, যেটার রেশ ফুরোয় না।
তখন অন্য দুজন মানুষ ভয় পায়। হাসিও যে ভয়ের হতে পারে ওরা দুজনে তা অনুভব করে। সুখদীপ রাহনুমকে জড়িয়ে ধরে। রাহানুম। আবুল হাশেমের হাত চেপে ধরে বলে, অত আইস্যে না, বাবো।
আবুল হাশেম রাহামের মাথায় হাত রেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলে, ক্যা, হাসুম না ক্যা?
জানো না যত হাসি অত কান্না, কইয়া গেছে রাম সন্না।
কান্দনের আর বাহি কি? কান্দনতো মোর ফুরাইয়্যা গেছে। মুই আর কাম না।
এহন মোগ হপ্পন দেহনের সময় না বাবো?
হ্যাঁ, সত্য কথা।
বড়ো একটা শ্বাস ফেলে আবুল হাশেম কথাটা বলে।
শ্বাস ফেললা ক্যা, বাবো?
রাহানুমের কণ্ঠ বড়ো বেশি আন্তরিক। আবুল হাশেমের কোনো জবাব নেই। দীর্ঘশ্বাস তো ও ফেলতে চায়নি, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওর কিসের দুঃখ? ওতো দুঃখ কাটিয়ে ওঠার জন্য কতকিছু আপন করেছে। এই একা একা ঘুরে বেড়ানোটা তার একটা অংশ। তবে কেন, কিসের জন্য দীর্ঘশ্বাস। পূর্ণিমার গোল চাঁদও তো ওর আপন করে নেওয়া জিনিসের অংশ–মানুষ এবং প্রকৃতিকে ও সমানভাবে আপন করতে পেরেছে–সেইসব কিছুতে নিজের স্বস্তি খুঁজেছে, ভালো লাগা জড়িয়েছে। তবু গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক। ভেঙে। সমুদ্রের ওপর অভিমান হয়। কেন? কেন এই অর্থহীন মন খারাপ?
অনেকদিন আগে তো জীবনের বড়ো একটা অংশ চুকেবুকে গেছে–এই চুকে যাওয়ার ফলে ওর নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। মানুষের নতুন যাত্রা যতই দুঃখের ভেতর থেকে শুরু হোক না কেন যাত্রা তো আনন্দ। নতুন পথের আনন্দ, নতুন আলোর আনন্দ। ক্লান্তি মনে করলেই ক্লান্তি। ক্লান্তিকে বেশিদিন বয়ে বেড়ানো যায় না–ওটা আপন থেকে ঝরে পড়ে। না ঝরলে কি বেঁচে থাকা সহজ হতো? সেই চুকেবুকে যাওয়ার দিনটি বুকে চেপে বসলে দীর্ঘশ্বাস আসে। অথচ এখন এমনও তো হতে পারে যে বিশাল একটা ঝড় উঠলে মধ্য সমুদ্রে হারিয়ে যেতে পারে ওর ট্রলার? তখন কি ও আবার কোনো চরে ভেসে উঠবে? দেখবে আর একটি নতুন জীবন ওর অপেক্ষায়? না, আর না।
কিন্তু কেন নয়? জীবনের কি শেষ আছে? শুরু করলেইতো হয়। শুরু করাটাইতো নতুনত্ব। এর জন্য কি বয়স লাগে? না, লাগে না। যত বয়সই হোক না কেন আমি স্বপ্ন দেখব। আমি আলোকিত করব জীবন। তখন সেই রঙিন মাছটা ভেসে আসে আবুল হাশেমের করোটিতে। বঙ্গোপসাগর নয়, কুয়োকাটার পূর্ণিমা যদি একটা দিগন্ত-বিথারী সমুদ্র হয় তবে একটা রঙিন মাছ সেই সমুদ্রে থাকবে। সেটা আবুল হাশেমের একার, আর কারো নয়। সেই মাছ শত কোটি হয়ে আবুল হাশেমের জাল ভরে দেবে, ঘর ভরে দেবে। ট্রলার গড়ে দেবে। ওহ্ একটা নতুন ট্রলার। ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেম যুবক হয়ে ওঠে। যুবক বয়স থেকেই। একটা নুতন ট্রলারের স্বপ্ন ছিল ওর, যে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হয়নি। ও জানে এখন আর হবার নয়। তবু সেই রঙিন করোটিতে কেলিবিলাসে মেতে উঠলে ও সমস্ত অনুভব নিয়ে চাঙা হয়ে ওঠে। শরীরের নতুন। পুলক, যেন প্রবল খরতাপে ভেজা বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দূরের বিন্দুর দিকে তাকিয়ে, যেখানে তাকালে মনে হয় আকাশের সঙ্গে সাগরের আলিঙ্গন। এইসব ভাবনায় আবুল হাশেমের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর। ভারি আনন্দ হয়। ইচ্ছে করে দৌড়ে উঠোনটা এক পাক ঘুরে আসতে।
ততক্ষণে ওরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝকঝকে তকতকে নিকোনো উঠোন। রাহানুম ভিটেবাটি ছিমছাম করে রাখতে ভালোবাসে। বারান্দায় হোগলার মাদুর পাতা। সুখদীপ দৌড়ে গিয়ে মাদুরের ওপর গড়িয়ে পড়ে, ডিগবাজি খায়। আবুল হাশেম নিজেকে বলে, আমি তো এখন সুখদীপ হয়ে গেছি। একদম ওর মতো, ওর বয়সী। তখন সুখদীপ দৌড়ে এসে আবুল হাশেমের হাত ধরে বলে, দাদা, গপ্পো–
ধমকে ওঠে রাহানুম, কেবল গপ্পো? বাবো ভাত খাইবে না?
সুখদীপ রাহনুমকে ভেংচি কাটে। তারপর দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, মোরও খিদা লাগছে।