আবুল হাশেমের আর উঠতে ইচ্ছে করে না। সাগরের জোয়ার আসছে–মৃদু গর্জনধ্বনি ওর কানে সংগীতের মতো ভেসে আসছে। যেন মণিমালার কোলজোড়া প্রথম সন্তান। ও গুনগুনিয়ে গান গেয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। প্রথম সন্তানে কি খুশি ছিল ও! চকচক করত ওর দৃষ্টি। নাকি মাতৃত্বের প্রকাশটাই অমনি–এতদিনেও আবুল হাশেমের কাছে এই বোধটা পরিষ্কার নয়। জোয়ারের কলতান শুনতে শুনতে ও নিশি-পাওয়া মানুষের মতো উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কুকুরটা নেই। কখন চলে গেছে ও টেরই পায়নি। ও আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে শুরু করে।
তখন আবুল হাশেম দেখতে পায় সুখদীপ দৌড়তে দৌড়তে আসছে। চিৎকার করছে, দাদা, দাদা গো–আবুল হাশেমের বুক ধুকপুক করে, আহা, ওই সাত বছরের বালক জানে না যে আবুল হাশেম ওর কেউ নয়। ও কত গভীর স্বরে ডাকে। যেন ওর সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। কোনোদিন বুঝি এ নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হবে না। ওদের উঠোনে জ্যোৎস্না বিছিয়ে থাকলে সুখদীপ আবুল হাশেমের কোল দখল করে বসে। বলে, দাদা এউক্কা গল্প কয়েন?
গল্প? কী গল্প কমু?
যা আমনহের ইচ্ছা।
আবুল হাশেম বুঝে পায় না যে কি গল্প বলবে। কত গল্প তো সুখদীপকে বলা হয়েছে। রাজা, রানি, রাজকুমার, রাজকন্যা, দৈত্য-দানব থেকে শুরু করে হাতি-ঘোড়া, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, সেপাই-লস্কর সব শেষ। এমনকি সমুদ্রের গল্প, মাছ ধরার গল্পও করা হয়েছে। শুধু সুখদীপের নিজের গল্পটি বলা হয়নি। ওকে বলা দরকার। কবে? কখন? কেমন করে? সুখদীপ কি এই গল্প রূপকথা শোনার মতো আগ্রহ নিয়ে শুনবে? না কি শুনতে চাইবে না? কেমন করে বললে ওর শুনতে ভালো লাগবে? এটাই বুঝি হবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্প শোনা? ও মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে বলে, আমি জানি না। আজো সুখদীপ দৌড়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে রাহানুম। ওরা ঘুমোয়নি। ওরা ওর জন্য অপেক্ষা করেছে। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছে। রাহামের ছায়াটা দু’পাশের গাছ-গাছালির সঙ্গে মিশে যায়। রাহানুম নারী। নারীর ছায়ায় ঘ্রাণ আছে। আবুল হাশেমের অনুভূতি গাঢ় হতে থাকে। একদিন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আবুল হাশেম অজস্র ঝরাপাতা মাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্ষার জলে সে পাতাগুলো নরম হয়েছিল। এখন নরম কোনোকিছু স্পর্শ করলে ওর শরীরে শিহরণ জাগে। ও ভুলে যায় ওর বয়সের কথা। ও সেদিন ভেবেছিল বর্ষার জলে ভিজে থাকা ঝরাপাতা নারী। নারী ভাবতেই ওর সমুদ্রের কথা মনে হয়। ওর কাছে সমুদ্র নারী। যার গর্ভ থেকে ওর জাল ভরে রূপোলি মাছ উঠে আসে। নারী ছাড়া কে আর এমন উজাড় করে দেয় নিজেকে? সৈকতের ভেজা বালুও ওর কাছে নারী। পায়ে জড়িয়ে থাকে প্রবল মমতায় কিংবা প্রিয়তমা হয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকদূরে চলে যাবার মন্ত্রণা দেয়। স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে চলে যায়, পেছনের কিছুই মনে থাকে না। নারী ছাড়া কে এমন দিগ্বিদিক পাগল করা ডাক দেবে? এতকিছুর মধ্যে ও একা, একজন মানুষ, যার পৌরুষ আছে, ক্ষমতা আছে এবং শক্তি আছে। তাই আবুল হাশেম নিজের বয়সের কথা ভুলে যায়।
বয়সের কথা ভুলে যাওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড সুখ আছে। ওর কাছে তা এক ধরনের নতুন জন্ম। আবুল হাশেমের মনে হয় ও প্রতি মুহূর্তে নতুন। জন্মের স্বাদ অনুভব করে। ওর নারীকে নিয়ে ভাবনায়ও এমন বোধ কাজ করে। যে-কোনো কিছুকে নারী ভাবা এবং তার সংলগ্ন হওয়া মানে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। যেমন করে সুখদীপকে হাজার রকমের গল্প শোনায়, গল্প বলার হাজার টং বের করে তেমন করে নিজের সঙ্গে এই প্রতিদিনের সখ্য। ফলে আবুল হাশেমের মন-মাতানো দিনযাপন। ও সুখদীপের মাথাটা আঁকড়ে ধরে বলে, দাদা তুমি ঘুমাও নাই?
ঘুমামু ক্যা? আমনহে যে ঘরে নাই? আমনহে ঘরে না থাকলে মোর ঘুম আয় না।
ততক্ষণে রাহানুম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে কেমন ভিন্ন নারী মনে হয়। মনে হয় না যে অনেককাল আগে এই মেয়েটির সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। মেয়েটি ওকে বাবা ডেকে ওর আশ্রয়ে নিজের দুঃখ ভুলেছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। এখন কি মেয়েটির মনে কোনো দুঃখ আছে? ও কি প্রতি মুহূর্তে নুতন জন্মের স্বাদ অনুভব করে? পালিয়ে যেতে চায় কোথাও? অনেকদূরে? আর কারো কাছে? হয়তো না। মেয়েটি সরল। ও গভীর করে কিছু ভাবে না। বড় কোনো আকাভক্ষাও নেই? না কি ওর সামনে কোনো সুযোগ নেই? সুযোগ এলে ও হয়তো তা কাজে লাগাবে। রাহানুমের কণ্ঠস্বর বড়ো সুন্দর। সেই কষ্ঠে আজ অভিযোগ, বাবো, আমনহে যে ক্যা এইরকম করেন?
কি হরি?
ক্যা পাগলামি?
তোমাগো কষ্ট অয়।
রাহানুম চুপ করে থাকে।
কতা কও না ক্যা মা, মুই তোমাগো জ্বালা দি?
জালা দিবেন ক্যা? জালা তো আমনহের। আমনহের তো অনেক জ্বালা। এই বয়সী মানহের পরিবার না থাকলে কি যে কষ্ট অয়!
আবুল হাশেম মনে মনে বিড়বিড় করে, কষ্ট কী? তিনজন মানুষ একত্র থাকলে আবার কষ্ট কী? অন্ধকারে রাত গাঢ় হয়। অন্ধকারে মমতা বাড়ে, অন্ধকারে মমতা ছিন্নভিন্ন হয়। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য নারকেল গাছ। নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে আকাশ একটা রেখার মতো। বর্ষায় গাছ-গাছালি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। কী নরম, কী সতেজ, কী সবুজ! এই সবের মধ্যে রাহনুমের উপস্থিতি বড়ো বেশি তীব্র।
সুখদীপের হাত ধরে আবুল হাশেম সামনে হাঁটে, পেছনে রাহানুম। ও একরোখা মেয়ে, রাগ বেশি। পান থেকে চুন খসলে রেগে যায়, বকাবকি করে। আবুল হাশেম চুপচাপ শোনে। কখনো রাহালুমের সঙ্গে কোনো বিরোধে যায় না। ও মহাজনের বাড়িতে ধান ভেনে বছরের খোরাক জোগাড় করার চেষ্টা করে। পারতপক্ষে আবুল হাশেমের কাছে। হাত পাতে না। সুখদীপকে ওরা দুজনেই দেখে। ও দুজনেরই। কিছুদূর গিয়ে আবুল হাশেম পেছন ফিরে দাঁড়ায়। রাহানুম খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সুখদীপ চেঁচিয়ে ডাকে, মা তরতরি আও?