থুঃ বুড়া হগুন। নিজের বয়সের হিসাব নাই।
ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আবুল হাশেম। চেঁচিয়ে বলে, কি কইলা? কি কইলা? বেডা মানষের আবার বয়স লাগে নাহি? বেড়া মানুষের জোয়ানি শ্যাষ অয় না। মুই দেহায়ে ছাড়ুম।
কচু। থুঃ।
গদু মাতবর বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে চলে যায়। আবুল হাশেম পেছনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। গদু মাতবর ভ্রুক্ষেপ করে না।
আবুল হাশেম কিছুক্ষণের জন্য আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। গদু মাতবর মুন্সির বাড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেলে ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। মুহূর্তে উড়িয়ে দেয় এতক্ষণের বাগবিতণ্ডা। নিজের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে ওঠে। ও নিজেই নিজের হাসিতে শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন, ও ঠিক করে আগামীকাল ভোরেই মাছ ধরার জন্য বেরিয়ে পড়বে। দিন সাতেক সমুদ্রে থেকে এসে বিয়ের জন্য কনে খুঁজে বের করবে, ওর সমস্ত সম্পত্তি বাজি, তবু কুমারী মেয়ে চাই এবং সন্তান।
আবুল হাশেম হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে আসে। ট্রলার ঠিকঠাক করে মহাজনের বাড়ি যাবে জাল গোছাতে এবং অন্য সঙ্গীদের খবর দিতে। জোয়ারে ট্রলার দুলছে। ও লাফিয়ে ট্রলারে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে। ছোটবেলায় গাছে দড়ি বেঁধে যেমন দোলনায় দুলত, তেমন আমেজ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ও গুনগুনিয়ে ছড়া কাটে। চোখ বন্ধ করে, চোখ খুলে রাখে। পানিতে পা ভেজায় আবার পা উঠিয়ে নেয়। ছড়ার লাইন ভুলে গিয়ে মুখে গুনগুন শব্দ করে, যেন ও একটা থেকে আর একটা অবলম্বনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। একসময়ে ও জোয়ারের হাঁটুজলে পা ড়ুবিয়ে। ছেলেবেলার মতো হেঁটে হেঁটে পাড়ের দিকে এগুতে থাকে। সূর্য পাটে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আলো নিভবে।
তখন ও দেখতে পায় পুবদিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে একটি লোক আসছে। অচেনা না চেনা মানুষ, তা দূর থেকে ঠাহর করতে পারে না, শুধু ভঙ্গিমা চেনা চেনা লাগে মনে হয়, যেন পরিচিত কেউ। ও কে? কেন দৌড়চ্ছে? হয়তো ভিন গাঁয়ের কেউ। কারো জন্য সুখবর আনছে, নাকি দুঃসংবাদ? আবুল হাশেম আবার ট্রলারের কাছে ফিরে যায়, মনে হয় একটা ভয়ানক অবলম্বন চাই। অবলম্বনহীন দাঁড়িয়ে থাকলে ও জোয়ারের তোড়ে ভেসে তলিয়ে যাবে। লোকটি কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন ওকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট অবয়ব আর নেই, একজন জোয়ান তাগড়া লোক। লুঙ্গি মালকোচা মেরে পরা, হয়তো দৌড়নোর সুবিধার জন্য। গায়ে গেঞ্জি, লোকটি বড়ো বড়ো পা ফেলছে, খুব দ্রুত ওর দিকেই আসছে। তবু লোকটি কে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আবুল হাশেমের আরো কিছুক্ষণ সময় লাগে। কাছে এলে ও চিনতে পারে, গফুর, জবেদ আলীর চাচাতো ভাই।
গফুর ওকে এখানে পাবে আশা করেনি, তাই দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, মহাজন।
তারপর জোয়ারের জল উপেক্ষা করে দৌড়ে ট্রলারের কাছে আসে। মহাজন সব্বোনাশ। সব্বোনাশ?
লোকটি হাঁফাতে থাকে। কথা বলতে পারে না। ওর দম নেওয়া প্রয়োজন–ওর বুক ঘন ঘন ওঠানামা করছে। পেট পিঠের সঙ্গে লেগে আছে, রোদে পোড়া গায়ের চামড়া, গলার চারপাশে ঘাম শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে। লোকটি ট্রলারের সামনের দিকটা ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাচ্ছে। একসময় ওর নিঃশ্বাস পড়া শান্ত হয়। এতক্ষণ আবুল হাশেম একটি প্রশ্নও না করে, ওকে দম নেবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়। কিভাবে এত সহিষ্ণু হলো? দুপুরের ঘটনার পর ও কি ধৈর্য ধরতে শিখে গেল? এই ধৈর্য ধরার অর্জন মানুষের জন্য কখনো কখনো ভীষণ জরুরি, যখন মানুষের চারদিকে সর্বনাশের শুকনো পাতা ওড়ে। তাই সর্বনাশ শব্দটি শোনার পর থেকে ওর ধৈর্য আরো বেড়ে যায়। ও একমনে গফুর মিয়ার হাঁফ-ধরা বুকের ওঠানামা দেখে।
গফুর মিয়া খানিকটা ধাতস্থ হলে আবুল হাশেম বলে, খবর ক দেহি।
কাইলকা নুরু মোল্লা নতুন চর দুখল কইরা নিছে। রাইতে জবেদ ভাইর ঘরে আগুন দেছে। ভাই-ভাবি পুড়া মরছে। এক্কেরে অঙ্গার হয়া গেছে মহাজন।
গফুর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
আবুল হাশেম নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অঙ্গার? অঙ্গার কি? অঙ্গার কেমন? মানুষ কেমন করে অঙ্গার হয়? অঙ্গার হলে কেমন দেখায়?
তখনো কেঁদে যাচ্ছে গফুর।
আবুল হাশেমের মনে হয় ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে থেকে গফুর যায়। জেগে থাকে কান্নার শব্দ, যেন পৃথিবীতে ধ্বনি ছাড়া আর কিছু থাকতে নেই। কেবল ধ্বনিই পারে বিস্তৃত হতে। অল্পক্ষণে আবুল হাশেমের করোটিতে সে শব্দ পরিব্যাপ্ত হয় এবং ওর আর কিছুই মনে পড়ে না। ও নড়তে পারে না, হেঁটে কোথাও চলে যেতে পারে না। ওর পুরো অবয়ব যেন ট্রলারের সঙ্গে মিশে গেছে। ও পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।
দেখে আকাশের সীমানা থেকে দিগন্তরেখার কাছাকাছি দুজন মানুষ অঙ্গার হয়ে ঝুলে আছে–এতক্ষণে ও বুঝতে পারে অঙ্গার কি, অঙ্গার কেমন। রাহামের জন্য ওর চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সে জল গাল বেয়ে গড়ালে ও বুঝতে পারে যে নতুন চরটি হাতছাড়া হয়ে গেল–ওটা দখল করা ওর কোনোদিন হয়ে উঠবে না, কারণ ওর সেই লোকবল নেই, অর্থবলও নেই।
তখন ও গফুরের দিকে তাকায়। ওর কান্না থেমে গেছে। চোখও মোছে না। শান্ত হয়ে ট্রলারের ওপর মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছু ভাবছে, কিছু সমাধানের কথা। কিংবা নতুন করে শুরু করার জন্য কিছু। নয়তো আবুল হাশেম থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে আছে।
আবুল হাশেম উৎকণ্ঠিত গফুরকে বলে, তুই বাড়ি যা গফুর। মুই একটু পর আমু।