গদু মাতবর হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। আবুল হাশেম সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, যেন। বলতে চায় এ এক রাজ্যজয়ের খবর। এখন ওর বীরদর্পে হেঁটে যাবার সময়। ও গদ মাতবরের চোখে চোখ ফেলে ভরু উঁচ করে, যেন জিজ্ঞেস করতে চায় অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? কিন্তু কথা বলে না, যেহেতু গদু মাতবরের মুখে রা নেই। তাই আবুল হাশেম কথা বলে ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে চায় না। ওর সামনে দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যায়–এখন ওর অমন করে হাঁটার সময়–এখন ওর বয়সকে উপেক্ষা করার সময়–কারণ ওর সামনে নতুন বসতির স্বপ্ন। ও এক নতুন দ্বীপে এসে ঠেকেছে–সামনে অনেক কাজ। জঙ্গল কাটতে হবে, মাটি তৈরি করতে হবে, ক্ষেত বানাতে হবে–ফসল বুনতে হবে। খোলা দ্বীপের ওপর দিয়ে ছুটে আসে হা-হা বাতাস–বিশুদ্ধ স্নিগ্ধ বাতাস, বুকভরে টেনে নিয়ে ওর ভেতরটা সাফ-সুতরো হয়ে যায়। কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, এখন কেবলই স্বপ্নের সুখ।
নূরবানুর ভাইকে বিয়ের কথা বলতে পেরে ও খুব হালকা বোধ করে। বীরদর্পে হাঁটলে কোথাও অকারণে দাঁড়ানো যায় না—এমন জায়গায় এসে থামতে হয় যেটা নিজস্ব সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্য দিশপাশহীন। সেজন্য ও আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা সৈকতের চরে আসে। এটাইতো জায়গা, যেখানে নিজেকে খুলে ফেলা যায়। ওর এখন দরকার ওর নিজের মুখোমুখি হওয়া–আনন্দ, অপার আনন্দ চারদিকে থৈ-থৈ করছে। নতুন কোনো কিছুর শুরুতে মানুষের ভেতরে যেমন তীব্র উত্তেজনা থাকে আবুল হাশেমের মধ্যে এখন সেই উত্তেজনা। সৈকতে দাঁড়িয়ে ও একবার বনভূমির দিকে তাকায়, একবার সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র ওকে প্রেরণা দেয়, বুকের ভেতর আনন্দের গর্জন। বনভূমির দিকে তাকালে মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়–সংসারের কোলে নিবিড় শান্তি। আজ আর সোজা পূর্ব বা পশ্চিমে হাঁটে না ও। উত্তর-দক্ষিণে সাগর এবং বনভূমি বরাবর পায়চারি করতে থাকে। শুনতে পায় চারদিকে প্রবল তোলপাড়–কারা ডাকছে আবুল হাশেমকে? মণিমালা কি? না মণিমালার ডাক ও আর শুনবে না। ও আর পেছন দিকে যাবে না। এখন ওর সামনে নূরবানু। কতদিন আগে যেন নূরবানুকে একবার দেখেছিল? এখন আর মনে নেই। নূরবানুর কথা মনে হতেই শরীর শিরশির করে যেন পায়ের নিচ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে বালুকণা বলছে, চলো অন্য কোথাও যাই। প্রতিটি বালুকণা নূরবানুর মুখ সেই ভুরু, নাক, চোখ, ছিপছিপে শরীর–সর্ব অবয়ব। নূরবানুর কথা ভাবলে আবুল হাশেমের পা থেমে যায়, ও দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে মোষের সারি ঘরে ফিরছে–কালো কুচকুচে মোষগুলো প্রকৃতির পটভূমিতে এক একটি বিশাল নক্ষত্র।
পরদিন দুপুরের পর গদু মাতবর ওর বাড়িতে আসে। ওকে দেখে আকস্মিক খুশিতে বিমূঢ় হয়ে যায় আবুল হাশেম। নুরবানুর ভাই তাহলে রাজি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সুখবরটা বাড়ি বসে পাবে ধারণাই করতে পারেনি। দুপুরের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। চমৎকার রান্না করে ওর খালা, মনে হয় এতদিনকার জীবনযাপনে এ রান্না একদম অন্যরকম। আয়েশ করে গড়িয়ে নিচ্ছিল বিছানায়। খানিকক্ষণের জন্য সামান্য তন্দ্রার মতো হয়। একটা ভালো স্বপ্নও দেখে। মনের এই প্রশান্ত অবস্থায় নূরবানুর ভাই, অর্থাৎ সৌভাগ্য। আবুল হাশেম তাই গদু মাতবরকে দেখে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে উঠে বোকার মতো হাসে। তড়িঘড়ি হাতলবিহীন চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, বয়েন।
বইতে আহি নাই।
নূরবানুর ভাই গম্ভীর–মুখজুড়ে বিরক্তি, দুই ভুরুর মাঝখানে কপালটা কুঁচকে থাকে। সেই থাকার ফলে চোখ ঘোট দেখায়। আবুল হাশেম আনন্দে বিহ্বল হয়ে ওঠার ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না, গদু মাতবরের তিক্ত চেহারা প্রথমে খেয়াল করেনি। তাই উত্তরটা শুনে ও চমকে ওঠে এবং নিজের কাছে ধাক্কা খায়।
হোনেন হাশেম মিয়া মোর বইনে কইছে আমনহেরে ছামনে পাইলে দাও দিয়া কোপাইয়া কাইড়া ফালাইবো। কইছে, আমনহের এ্যাতো সাহস অইল ক্যামনে যে আমনহে বিয়ার কতা কন?
আবুল হাশেম চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, যেন নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল এই লোকটিকে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল, বিনয়ী, ভদ্র মনে হয়েছিল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন আবুল হাশেমের একজন খাটি দরদি। আর আজ এখন? গদু মাতবর মাটিতে পা দাপিয়ে বলে, এই কতা আমনহে। গেরামের কারো কাছে কইতে পারবেন না। মোর বইনের য্যান কোনো দুর্নাম না অয়। যেই কতা মুখ দ্যা বাইর করছেন তা আবার গিলা ফেলেন। একদম চুপ, খামোশ!
আবুল হাশেমের মুখের ওপর আঙুল নাড়ায় গদু মাতবর। আবুল হাশেমকে তা সহ্য করতে হয়। গদু মাতবরের ওপর ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না, কারণ গদু মাতবর ওর চেয়ে তাগড়া। তাছাড়া ও নূরবানুর কাছ থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছে। সেটাই এখন ওর বড়ো বর্ম। আবুল হাশেম দাঁতমুখ খিচিয়ে রাখা গদু মাতবরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় লোকটির মুখটা আর মুখ নেই–ওটা কাঁকড়া হয়ে আট পায়ে আবুল হাশেমকে রক্তাক্ত করছে।
যা কইলাম মনে থাহে’য্যান। না অইলে ফাটাফাটি অইবো। মোর বইনে কইছে একটা কতা য্যান এইদিক ওইদিক না অয়। অহন যাই।
খাড়াও।
প্রবলভাবে চিৎকার করে ওঠে আবুল হাশেম। এতক্ষণে ও নিজের ভেতর আত্মস্থ হতে পেরেছে। তর্জনী তুলে কঠিন স্বরে বলে, হোনো, তোমার বইন ছাড়া গেরামে আর মাইয়া নাই? মুই বিয়া করমু। অহন ঠিক করলাম কুমারী মাইয়া বিয়া করমু, মোর বেবাক সম্পত্তি দিলেই মাইয়া পামু। মোরও পোলা অইবো। তোমরা দেইখা লইও।