পরদিন রাহানুম চলে গেল। যাবার সময় ভীষণ কান্নাকাটি করল। আবুল হাশেম ওকে নুতন জীবন দিয়েছে এমন কথা বলতে ভুলল না। সালাম করতে গিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়েছিল ও। কান্নার দমকে অনেকক্ষণ উঠতে পারেনি। আবুল হাশেম ওর মাথায় হাত রেখে ভেবেছিল যেন নিজের মেয়ের বিদায় দিচ্ছে ও। মুহূর্তে কেমন অবশ লাগে ওর, এই আন্তরিকতাটুকু কি সত্য নয়? সেই থেকে নিজের ভেতরে খটকা থেকে গেছে। অনেক ভাবনাই মেলাতে পারছে না।
এখন শূন্য ঘরবাড়ি। আবুল হাশেম তার দূরসম্পর্কের খালাকে আনিয়েছে কিছুদিনের জন্য। অবশ্য বয়সে আবুল হাশেমের ছোট–নিঃসন্তান বিধবা। কিন্তু বাপের সংসারে তার প্রয়োজন ভীষণ, তাই বেশিদিন থাকতে পারবে না। চুপচাপ থাকে। সাত চড়ে মুখে রা নেই। বাড়িতে আছে কী নেই সেটাও ঝেঝা যায় না। মাঝে মাঝে মহিলার ওপর বিরক্ত হয় আবুল হাশেম। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই, বলা যায় না। আবুল হাশেম ঘরে বউ আনলে এই খালা চলে যাবে।
কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল এই নিঃসন্তান মহিলাকে তার সংসারে রেখে দেবার জন্য। যে কটা দিন বাঁচে সে কটা দিন নিরবিলি কাটিয়ে যাক। ভাইয়ের সংসারে বেচারাকে এই বয়সেও গাধার খাটুনি দিতে হয়। কিন্তু আবুল হাশেম ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ঘরে বউ আনলে অন্য কাউকে এখানে রাখবে না ও। তাতে সংসারে অশান্তি। তাছাড়া অন্যের বোঝা টানার ইচ্ছেও ওর নেই। এখন ঝামেলামুক্ত জীবন চায়–চায় যৌবনের নিরিবিলি গৃহকোণ, যেখানে শুধুই দুজন, স্বপ্ন এবং খুনসুটির দিনরাত। আবুল হাশেম বাড়ির আঙিনা, চারপাশ ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য লোক ডাকে, নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করে। কোথাও একফোঁটা ময়লা রাখতে চায় না। মুহূর্তে থমকে চায় ওর চিন্তা। তাহলে কি রাহানুম আর সুখদীপ ওর জীবনে আবর্জনা ছিল? যে ময়লা উড়ে গেছে বাতাসের ঝাঁটাতে? ওর চারদিক এখন সাফ-সুতরো–ময়লা নেই কোথাও? আহ না, এমন করে ভাবা উচিত নয়। বড়ো কঠিন ভাবনা–নির্মম ভাবনা। হৃদয় মানে না এমন ভাবনা। ওর কষ্ট হয়। আসলে রাহানুম আর সুখদীপ ওর সুখের স্মৃতি। হাজার হলেও ও মানুষতো–মানুষেরই তো উচিত মানুষকে নিয়ে ভাবনায় থাকা। এতো স্বার্থপর হচ্ছে কেন ও? কেন এতো তাড়াতাড়ি উড়িয়ে দিতে চায় সুখদীপ আর রাহানুমকে? নিজের আচরণের জন্য ওর খুব লজ্জা হয়। প্রচণ্ড গ্লানি অনুভবের কারণে ও মুষড়ে পড়ে। সাফ-সুতরো পরিষ্কার বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে ওর কান্নাই পায়।
দুদিন লাগে ওর নিজেকে শক্ত করে তুলতে। তৃতীয় দিন বিকেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নূরবানুর ভাইয়ের কাছে যায়। প্রথমে বেশ অনেকক্ষণ জীবন-জগৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথা বলে, সে চিন্তায় বেশ খানিকটা দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন থাকে। নূরবানুর ভাই মুগ্ধ হয়েই। শোনে। একজন বুড়োকে কিছুটা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ও ভেতরে ভেতরে উদ্বুদ্ধ হয়। আবুল হাশেমকে ওর ভালোই রাগে। পরক্ষণে আবুল হাশেমের জন্য ওর মায়া হয়–আহা বেচারা, পুরা সংসার হারিয়ে কেমন একা হয়ে গেছে। রাহালুমের বিয়ে এবং সুখদীপের চলে যাওয়ার খরবতো গায়ের সবাই জানে। আবুল হাশেম এখন একা একা কেমন করে থাকবে, ভাবতেই নূরবানুর ভাই দুরুদ অনুভব করে। মানুষ এভাবেই একজন আর একজনের কাছাকাছি চলে আসে। ভেতর থেকে পানসুপোরি আসে। আবুল হাশেম আয়েশ করে পান খায়, আঙুলের ডগায় চুন তুলে নেয়। পানের বোঁটা দিয়ে নাক চুলকায়। উসখুস করে নূরবানুর ভাই। বুঝতে পারে না একজন বুড়োকে আর কতক্ষণ সম্মান করতে হবে। দুজনে মিলে হাটের দিকে গেলে কেমন হয়? ও তখন ধীরে সুস্থে বলে, যেন কথাটা আবুল হাশেমকে স্মরণ করাচ্ছে এমন ভঙ্গি, আইজতে হাটবার, না? লন, হাটে যাই। মেলা সওদা করা লাগবে।
আবুল হাশেম চমকে তাকায়, সওদা? মোর সওদা লাগবে না।
মোর লাগবে।
আবুল হাশেম ওর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলে, তোমার লগে মোর এটটু কতা আছে গদু মাতবর।
কতা? কি কইবেন? কন।
আবুল হাশেম সরাসরি কিছু বলতে পারে না। অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে নূরবানুকে বিয়ের কথা বলে। চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে যায় নূরবানুর ভাই। আবুল হাশেম এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারে তা ও ভাবতেই পারেনি।
নূরবানু ওর একমাত্র বোন। বছর দশেক আগে বিধবা হয়েছে। ছেলেমেয়ে নেই। ওর সংসারে থাকলে নূরবানুকে ও কখনো বোঝা মনে করেনি। বরং নূরবানু ওর সংসারের হাল ধরেছে বলে ওর বউ খানিকটা শান্তিতে আছে। ছেলেমেয়েগুলো তো সব ফুফু বলতে অজ্ঞান, ধানের মৌসুমে ওর স্ত্রীতো নুরবানু ছাড়া অচল। এসবের বাইরেও ওর সংসারে নূরবানুর এক গভীর মমতার স্থান আছে। তাছাড়া নুরবানুর বয়স নেহাৎ কম নয়, এ বয়সে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে?
নূরবানুর ভাই গদু মাতবর, গায়ের কেউকেটা নয়, তবে অবস্থা একদম খারাপও নয়, নিজের মান-সম্মানের ব্যাপারটি চিন্তায় রাখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমনহে এইডা কি কইলেন?
ক্যা, খারাপ কত?
এই বয়সে কি আর বিয়া অয়?
অয় না ক্যা? বিয়া বইলেই অয়।
আবুল হাশেম মুচকি হাসে। বলে, আন্ধারমানিক নদীর মধ্যে মোর জায়গাগুলা জাইগ্যা উঠছে। মোর পোলা লাগে। জমির মালিক অইবে।
আমনেহ পাগল অইলেন?
পাগল হমু ক্যা? এইডাই সত্যি কতা। বংশ না থাকলে কী অয়? আমনহে আমনহের বইনেরে জিগাইয়া দেহেন। মুই আজ যাই। কাইল। আবার আমু।