আবুল হাশেম চেঁচিয়ে কড়া কণ্ঠে বলে, ঘরে ল। মায়ামানের আন্দারে গাছের তলায় থাহা ভালা না।
মোর গাছের তলায় থাকতে ভালা লাগে। কত পক্ষী বোলে।
ঘরে ল।
আবুল হাশেমের কণ্ঠে প্রচণ্ড ধমক, যেন রাহালুমের সামনে এক বিস্ফোরণ। ওর দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। কোনোদিন আবুল হাশেম ওর সঙ্গে এমন ধমক দিয়ে কথা বলেনি। পরক্ষণে মনে হয় ও নিজেও আবুল হাশেমের সঙ্গে এমন আচরণ করেনি। কত দ্রুত এবং কত অল্প সময়ে সংসারটা ওলটপালট হয়ে গেল। রাহানুম যে আচরণের সঙ্গে এতদিন পরিচিত ছিল না, আজ সে আচরণের শুরু। এখন ও ধমকের পরেও নড়ে না।
কি, গেলি না?
মুই যামু না। আমনহে যান।
আবুল হাশেমের রাগ পড়ে যায়, অসহায় বোধ করে। আবার ওর মধ্যে পরাজয়ের গ্লানি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আজ দুপুরে ও জবেদ আলীর বাপের কাছে পরাজিত হয়েছে। এখন রাহানুম। ভাবতেই ওর শরীর শিউরে ওঠে। নড়তে পারে না, অন্ধকারে ওর হাঁটু কাঁপে। কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আবুল হাশেম এক বিপন্ন মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, মোর খিদা লাগছে মাগো?
এতক্ষণে রাহানুম নরম হয়। এই আবেদনের পর আর নিজেকে কঠিন রাখা সম্ভব নয়। ও নিজেও কোমল কণ্ঠে বলে, লন, ঘরে লন।
ও আবুল হাশেমকে পেছনে রেখে এগিয়ে যায়। গাছের নিচে রেখে আসে ওর ঘর-গেরস্তির স্বপ্ন। অজস্র জোনাকি সেই স্বপ্ন ঘিরে জ্বলতে থাকে। ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনির আবিষ্কার মানুষের জন্য, আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝি আলো ও ধ্বনি ছড়ায়। এবং এইসব অনুষঙ্গে জীবন ভরে উঠেছে বলেও শুধু পূর্ণিমা নয়, ঘোর অমাবস্যাও। চায়। অমাবস্যার অন্ধকারে হেঁটে যেতে ওর ভয় নেই।
কৃষ্ণপক্ষে ওর বিয়ে হয়। জবেদ আলীর বাপ চার-পাঁচজন লোক নিয়ে এসেছে। ছোট আয়োজন। নতুন শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট এনেছে। স্নাে, পাউডার, ফিতা-ক্লিপও দিয়েছে জবেদ আলী। আবুল হাশেম জবেদ আলীকে লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। পুকুর থেকে বড়ো মাছ ওঠানো হয়েছে, মুরগি জবাই হয়েছে, পোলাও রান্না হয়েছে। রাহানুম ভোররাতে উঠে এসব রান্নার আয়োজন করেছে। বরপক্ষ আসার আগেই সব কাজ শেষ। পাশের বাড়ির করম আলীর বউ ওকে সাহায্য করেছে। এত কাজ তবু কোনো ক্লান্তি নেই ওর। বরং মনে হয়। অন্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই হয়েছে। সময় যেন উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে। সময়ের হাতে আজকের দিনটি একটি বড়ো লাল ঘুড়ি, নাটাইয়ে সুতো ছেড়ে দিয়েছে, সে সুতোর কোনো শেষ নেই।
কাজ শেষে পুকুর থেকে গোসল করে আসার পর ভীষণ সতেজ লাগে নিজেকে, মনে হয় দিনটি যদি লাল ঘুড়ি হয়, তবে নাটাইয়ের সুতো। এখন ওর হাতে। ও ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে পারে। জবেদ আলীর পাঠানো নতুন কাপড়ের ভাঁজ খুললে সে গন্ধ ওকে মোহিত করে। সে শাড়ি পরার পর ওর আরো ঝকমকে অবস্থা। সোনালি জরির পাড়ের টকটকে লাল রঙের শাড়ি, সঙ্গে হলুদ রঙের ছিটের ব্লাউজ। বারবার আয়নায় মুখ দেখে ও। নিজের মুখই নিজের কাছে দারুণ মায়াময় মনে হয়। স্নাে মাখলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে, কাজলে টানটান হয়ে যায় চোখ জোড়া। আহ কী সুন্দর, কী সুন্দর। অভিভূত হয় রাহানুম। কতকাল, ও ভুলে গেছে কতকাল আগে ও এমন করে সেজেছিল। ছোট আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে ওর আশ মেটে না। মনে হয় ও কি নিজেই একটি লাল ঘুড়ি?
মৌলবি সাহেব এসেছে। বিয়ে পড়ানো হবে। রাহানুম চৌকির ওপর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। বুকের ভেতর থরথর কাঁপুনি, কেমন অস্থির লাগে, কিছুই ভাবতে পারে না–শুধু বুকের ভেতর একটি শব্দ কবুল, কবুল। এছাড়া ওর কাছে আর কোনো ধ্বনি নেই, আর কোনো অনুভব নেই–মুছে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেলে চলে যায় জবেদ আলীর বাপ ও অন্যরা। আজ রাতে আবুল হাশেমের বাড়িতে জবেদ আলী ও রাহানুমের বাসর। আগামীকাল ভোরে দুজনে চলে যাবে নতুন চরে।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে আবুল হাশেম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ওরা ঘরের ঝপ বন্ধ করেছে অনেকক্ষণ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুপিটা নিভিয়ে দিয়েছে ও। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকের ভেতর ভার-ভার লাগে। সাজানো গোছানো এই কয় বছরের জীবনে বেশ বড়ো পরিবর্তন হয়ে গেল। এই পরিবর্তনের ক্রান্তির সময়টুকু বুকে। বাজছে। আগামীকাল থেকে ও একা হয়ে যাবে, ওর পাশে কেউ থাকবে না। অমাবস্যা ওর ভালো লাগে না। তবু বসে রয়েছে ঘরের বাইরে, কী করবে, কোথায় যাবে? কোথায় স্থিতি? হঠাৎ হঠাৎ অনেক দূর থেকে রাতজাগা পাখির ডাক ভেসে আসে। মনে হয় দূর থেকে কেউ ডাকছে। কে? ডাকটা কি নিজের অন্তরের? ও মনেপ্রাণে তেমন কারো ডাক শুনতে চাইছে যে ওর নিজের ঔরসের কেউ, যার সঙ্গে ওর জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নতুন করে রাহানুম ওর বর্গাচাষীর বউ। এর বেশিকিছু তো নয়। হায় সম্পর্কের কি বিচিত্র বেড়াজাল! জবেদ আলী এ বাড়িতে আসার আগে ওরা কেউই ভাবেনি এমন একটা অদৃশ্য জলোচ্ছ্বাস প্রবল বেগে বয়ে যাবে ওদের ওপর দিয়ে। এখন থেকে রাহানুম ওর কাছের কেউ নয়। বর্গাচাষী স্বামীর মতো রাহানুম ওকে মহাজন বলবে কি?
আচমকা অন্ধকারে হা-হা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। অন্ধকারে সে হাসি ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিত হয়। হাসির রেশ ফুরিয়ে গেলে ও একটা বিড়ি ধরায়। বিড়ির আগুন অন্ধকারে একবিন্দু আলো। নাকের ওপর দিয়ে তাকালে চোখ থেকে সে আলোর বিন্দুটি একটি সরলরেখা। আবুল হাশেম এক সময়ে সরলরেখা সরিয়ে দিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়ে। সেটি একটি গোলাকার বৃত্ত হয়। ও দেখতে পায় না। আগুনের সরলরেখা এবং ধোয়ার গোলাকার বৃত্ত নিয়ে ওর স্নায়ু শিথিল হতে থাকে–অর্থাৎ ঘুম পাচ্ছে।