সেই খেলাটা এখন ওর মাথায় ভর করেছে। এই বালিয়াড়ির মধ্যে ও একটা লাল জড়ল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সেই সময়টাতো এখন ওর চারপাশে নেই–সেই বয়সটা নেই–সেই মাদকতাময় শিহরণও নেই। ও অল্পক্ষণে ক্লান্ত হয়ে যায়। মনে হয় চারপাশে গোঙানির শব্দ। সেই শব্দ হাতের মুঠিতে নিয়ে আজরাইল আসছে। ওহ, কেমন যেন লাগছে।
চারদিকে অজস্র লাল কাঁকড়া, শরীরে লাল কাঁকড়ার দংশন। আবুল হাশেমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও আর সামনে এগুতে পারে না। ফিরতে থাকে নিজের ঘরের দিকে। ঘর? ঘরটা কি ভুল ঘর? রাহালুমের বাবা ডাক কি ভুল? কিংবা সুখদীপের দাদা ডাক? এতক্ষণে আবুল হাশেমের বুকে হাঁফ ধরে। ওর আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। রাত কত জানে না। কোথাও কোনো মানুষ নেই। কেবল সমুদ্রের গর্জন। যে গর্জন একবার উন্মত্ত হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল কুয়োকাটার জনপদ।
কষ্ট ঘটনা কখনো কখনো নষ্ট ঘটনা হয়ে যায়–যে ঘটনা মনে করলে বুক তোলপাড় করে, মাথা ঘুরিয়ে ওঠে। ওই ঘটনা করোটিতে গেঁথে থাকে–সাগরে নোঙর ফেলে গেঁথে রাখা নৌকার মতো। ঢেউয়ে বা বাতাসে কেবলই দোলে। স্মৃতিও তেমন–সুযোগ পেলেই দুলে ওঠে। এই মুহূর্তে ও প্রাণপণে সেই ঘটনাটা ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
ও মনে করে ও এখন কুয়োকাটা থেকে আলিপুর বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে–যখন দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত কিংবা কেটে নেওয়া ধান গাছের নাড়া হা-হা শূন্যতা সৃষ্টি করে ভৌতিক হাসি হাসে তখন আবুল হাশেম ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে যায়। ও রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। সামনের জলাভূমিতে ব্যাঙ লাফায়। সেখান থেকে এক ধরনের শব্দ আসে। না, ঝিঁঝির ডাক নয়, কিসের ও জানে না। যেন এই শব্দটা ও কোনোদিন শোনেনি। অথচ মনে হয় চেনা–প্রতিদিনের শোনা। তবু সেই শব্দটা অজানাই থেকে যায়। আবুল হাশেম আনমনা হবার চেষ্টা করে। ওর চারপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলে। হাজার হাজার আলোর বিন্দু জ্বলে আর নেতে, জ্বলে আর নেভে। ও শুনতে পায় যে ওকে দেখে লোকে বলছে, আহা বেচারা। বলে, আহা বেচারার কেউ নেই। বেচারার কি যে কষ্ট! কষ্ট কী? কষ্ট কি জোনাকির আলো? নাকি ঝিঁঝির ডাক? আবুল হাশেম চিৎপাত ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে।
ও দেখে আকাশ–দিগন্ত এবং কতগুলো নকশা জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। ওর সামনে সবকিছু মুছে যায়–ঊরু থেকে স্ত্রীর লাল জড়লের চিহ্নও। যৌবনে এই জড়লটা দুজনের খুব প্রিয় বিষয় ছিল। নানা কথা হতো ওটা নিয়ে। আবুল হাশেমকে মণিমালা বলত, মুই যদি কোনোদিন হারাইয়া যাই তহন এই জড়ল দেইখ্যা মোরে বিছরাইয়া লইও।
ক্যা, তুমি হারাইয়া যাবা ক্যা?
হারাইয়া যামু ক্যা? ধর একটা বড় বইন্যা হইলো। সবকিছু ভাইস্যা গেল।
পাগল, তোমারে আমি ভাসতে দিমু না। বোহের লগে বাইন্দা রাখমু। মোরা কেউ হারাইয়া যামু না, কেউ না।
কথা বলতে বলতে আবেগে ছলছল করে উঠত আবুল হাশেমের চোখ। মণিমালা আঁচল দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিত। তারপর নিজের চোখও মুছত। দুজনের আবেগ থিতিয়ে গেলে মণিমালা খুব নিচুস্বরে বলত, বইন্যার কি ঠিক আছে? সাগরের কূলের মানু আমরা। বইন্যাতো মোগরে ভাসাইতেই পারে।
আর বইন্যার কথা না।
আবুল হাশেম প্রবল চুমুতে ওর ঠোঁটজোড়া বন্ধ করে দিত। মণিমালা তলিয়ে যেত সেই বন্যার তোড়ে। তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়ত টেরও পেত না।
কিন্তু তারপরতো বন্যা ঠিকই মণিমালাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কই খুঁজে পাওয়া তো আর হলো না। কোথায় ছিল ওর লাল জড়ল? একটা চিহ্ন নিয়েও কেন মণিমালা অপরিচিতের সঙ্গে মিশে গেল? কেন তাকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া হলো না? ঘাসের ওপর দু’হাত ছড়িয়ে রেখে আবুল হাশেম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পাশ দিয়ে একটা কুকুর হেঁটে যায়। কুয়োকাটার পূর্ণিমা আবুল হাশেমের চোখে কুকুরটিকে মানুষ করে দিলে ও কুকুরের লেজ ধরে টান দেয়। কুকুরটি বন্ধুর মতো ওর পাশে শুয়ে পড়ে। লেজ নাড়ে। জিভ বের। করে রাখলে ওর জিভ থেকে টপটপ করে লালা ঝরে। কুকুরটি একসময়ে আবুল হাশেমের গায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। এক সময়ে ওর মাথাটা আবুল হাশেমের পেটের ওপর রাখে। আবুল হাশেমের মেদহীন শরীর। নিঃশ্বাসে পাঁজরের হাড় ওঠে আর নামে। এক সময়ে ও কুকুরের মাথায় হাত রাখে। ওর ঘুম পায়। না, ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্রা। কোনো এক গভীর শব্দ বারবার ওর চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে। ওই শব্দটা আর্তনাদ হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন কুকুরটা লাফিয়ে উঠে ঘেউ-ঘেউ শব্দ করে ছুটে যায় বেশ খানিকটা দূরে। আবার ফিরে আসে–আবার যায়। ও হয়তো কোনো একটা খেলা পেয়েছে সেই খেলায় ও আনন্দ পাচ্ছে। আহ আনন্দ! আনন্দ কি কুকুরের ঘেউ ঘেউ? আবুল হাশেম উঠে বসে। সেদিন ওর আর আলিপুর বাজারে যাওয়া হয়নি। এভাবেই ওর অনেক কাজ নষ্ট হয়–ও নিজেকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে যায় এবং সবশেষে এক নিঃশব্দ পৃথিবীতে ক্রমাগত হামাগুড়ি দিতে থাকে। ওর যন্ত্রণা হয়, চামড়া পুড়ে যায় এবং এক ধরনের বোবা আতঙ্ক ওর করোটিতে পরিব্যাপ্ত হয়।
ঠিক এখন এই মুহূর্তে ও ঘরে ফিরতে চায়। হ্যাঁ ঘর। এখন ওর একটি ঘর আছে। সাগরে মাছ ধরে ঘরে ফিরে আসার মতো ঘর আছে। কেউ কেউ ওর অপেক্ষায় থাকে। তবে বাবা, মা, ভাইবোন নিয়ে ঘর নয়। যৌবনে যেমন একদিন একটি ভিন্ন মানুষকে নিয়ে, যে মানুষের গর্ভে সন্ত নি উৎপাদন করা যায়, তেমন মানুষ নিয়ে যে ঘর গড়ে তুলেছিল, সে ঘর এটি নয়। এই ঘর অন্য এক ঘর–এটিও তো গড়ে তোলা। তিনজন মানুষের একত্র অবস্থান কি ঘর? গড়ে তুললেই কি ঘর হয়? মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক জন্মায়, হয়তো জন্মায়, হয়তো জন্মায় না। তবু একত্র বসবাসের মধ্য দিয়ে এক ধরনের মায়া জন্মায়–সেটা হয়তো খুব গভীরভাবে নাড়ির পরতে বাধার মতো করে বাঁধে না কিন্তু শূন্যস্থানকে ভরিয়ে মানুষের ক্লান্তি কমিয়ে দেয়। ক্লান্তি? এই মুহূর্তে ক্লান্তির ভারে পা কেমন নুয়ে আসছে। এই জংলা পথটুকু পেরিয়ে ঘরে পৌছুতে কতদিন লাগবে। কতকাল?