ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। না, ঠিক অন্ধকার নয়, বিশাল গোল চাঁদের দিগন্ত জোড়া পূর্ণিমা থাকলে অন্ধকার হয় কী করে? হওয়া উচিত নয়। হওয়া ঠিক নয়। তবু হয়। কারণ অন্ধকার তো শুধু নিজের মন নয়, অন্ধকার প্রকৃতিতেও। ওর বামের বিশাল সমুদ্রটি অন্ধকার–ভীষণ, ভয়াল। ওর মনে হয় ওখানে পূর্ণিমার আলো পৌঁছায়নি, হয়তো কখনোই পৌঁছায় না। সেজন্য কখনো অকস্মাৎ ওটা বিশাল ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আবুল হাশেমের ডানে বনরাজি–সেখানে গাছের ছায়া–ছায়ার ঘনত্ব আছে–সেই ঘনত্ব হাঙরের পাখনার মতো ত্রিকোণাকৃতি, সেখানে আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না। ওর ভয় লাগে–ভয়ে বুক কুঁকড়ে যায়। এছাড়া ওর সামনে এবং পেছনে আলো–অপরূপ আলো–কুয়াকাটার পূর্ণিমার এই আলোটুকু একদম ওর একার। এই আলো বুকে নিয়ে ওর বয়স এখন বাহাত্তর। লোকে বলে, বাহাত্তরে বুড়া। ওরা ওর নাম প্রায় ভুলেই গেছে। তাতে ওর কোনো দুঃখ নেই। ও ভাবে, নামে কী এসে যায়। মানুষ ওকে চিনলেইতো হয়। মানুষের সঙ্গেই তো মানুষের সব যোগাযোগ–নামের কথা ভেবে মানুষকে কি দূরে ঠেলে রাখা যায়?
হাটের দিন এলেই ওর চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাটের দিনে ও মানুষের গায়ের গন্ধ পায়। সে ঘ্রাণ ওর মগ্ন চৈতন্য আলোকিত করে। আবুল হাশেম বিচিত্র পসরা নিয়ে বসে থাকা দোকানির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে। জিনিস কিনুক আর না কিনুক, সবার কাছে ও যায়। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে, কিছু উপদেশ দেয় কিংবা ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলে, কোথাও বা কথা বলার ফুরসত হয় না। দোকানি ব্যস্ত থাকে। আবুল হাশেমের মন খারাপ হয় না। চোখাচোখি হলেও মনে করে অনেক কথা হয়েছে। এই সব মানুষেরা সাগর এবং গাছের মতো। অন্ধকার এবং ছায়া আছে ওদের। বাড়তি আকর্ষণ ঘ্রাণ। সেটা অনেক মানুষ এক জায়গায় হলে টের পাওয়া যায়। নইলে সে ঘ্রাণ ঘন হয় না। ঘন না হলে তা আবুল হাশেমের ইন্দ্রিয় স্পর্শ করে না। মানুষকে ও বড়োমাপেই দেখে। মানুষকে ও মাছি বানায় না–মাছি বানাতে খারাপ লাগে–মানুষের অন্ধকার ও দূরে রেখে দেয়–মানুষের ছায়াটুকু কাছে রাখে–খুব কাছে, একদম বুকের কাছাকাছি।
হাটের দিন এলেই মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যেতে দেখে। এই দেখা ওর বাড়তি আনন্দ। সবকিছুর ভেতরে থেকে পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ। নিজের এইসব অনুভবগুলো আবুল হাশেমের কাছে ভীষণ দামী।
একদিন চৈতালি হাটে জমজমাট কবিগান বসেছিল। সেদিন গায়েনের সঙ্গে ধুয়া ধরে নেচেছিল। বলেছিল, ‘বাহাত্তরে বুড়া মুই, গায়েন তুই মোর পরানের সই।’ কেন এমন একটি কথা ওর মনে হয়েছিল ও তা জানে না। ওর বয়স বাহাত্তর না আরো বেশি নাকি আরো কম সেটাও ওর জানা নেই। ও পরে অনেক ভেবে দেখেছে যে ওর নিজের কবি হওয়ার বাসনা হয়েছিল। ওর ভেতরে কোনো কামনা জন্মালে রঙিন মাছটা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন ও নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। একটা কিছু করতে না পারার তাড়নায় ওর শরীর কাঁপতে থাকে। সে কাঁপুনি দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, অদৃশ্য। যাহোক সেই থেকে ও লোকের মুখে মুখে বাহাত্তুরে বুড়া হয়ে গেল। ক্ষতি কি? না, কোনো ক্ষতি নেই। ওর ভালোই লাগে। লোকে ওর নাম ভুলে যাওয়ার অর্থ তো ওর আর একটা জন্ম। আবুল হাশেম নতুন জন্মের চিন্তায় আনমনা হয়ে যায়।
ওর তো এখন সেই নতুন জন্মের রেশ চলছে। ও নিজে একটা নাটাইয়ের সুতো ধরে রেখেছে–নাটাইটা গড়াচ্ছে–আর সুতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, কী চমৎকার রঙিন সুতো। সেই সুতো ওর জন্য নকশা বানায়–সেই নকশায় পা রাখলে ওর স্বপ্ন প্রবল হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে এক গহীন অন্ধকার রাতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওর এক জীবনের সবকিছু ধুয়েমুছে গেছে। তারপর আবার শুরু–আবার স্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। এখন কি ওর সময় হয়েছে এই নতুন জীবন গড়বে, যাকে মানুষ নির্মাণ বলে? মেন ঘর গড়া যায়–যে গড়া বস্তু দিয়ে কিংবা মানুষ দিয়ে? ঘরের ভিটি বাঁধা হয়, বেড়া লাগানো হয়, ছনের চাল ওঠে–চাল ছেয়ে দেয় ঘরামি আরো কিছু মানুষ লাগে ঘর গড়তে–অন্তত একজন মানুষ–তারপর মানুষ বাড়ে এক থেকে দুই–দুই থেকে পাঁচ। জন্মের বেড়ে ওঠা তো এমনই। ওই বেড়ে ওঠায় গড়ার আনন্দ থাকে, সুখের কাপন থাকে।
তখন ওর রাহনুমের কথা মনে হয়। ভাবে, এখন কাথার নিচে রাহানুম ঘুমিয়ে আছে হয়তো। নিঃশ্বাসে ওর বুক কাঁপছে, মৃদু ওঠানামা। ওর নাকের বাঁশি ফুলছে আর কমছে। ঠোঁটজোড়ায় অদ্ভুত টান, জিভ দিয়ে চাটলে চমৎকার ভিজে থাকে। ওর নিমীলিত চোখের পাতায় গভীর কালো রেখা–যখন চোখজোড়া খোলা থাকে, চোখের তারায় ভাষা ফুটে ওঠে, ওহ! আবুল হাশেম বড়ো বেশি নিঃশব্দে নিজেকে শাসন করে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বালু খুঁচিয়ে বলে, যেভাবেই হোক আমি ওর বাবা। কারণ ও আমাকে বাবা ডাকে।
প্রচণ্ড রকমের ধমক দেয় নিজেকে। তাহলে এই বয়সে মানুষের সবকিছু কি ফুরিয়ে যাবে? কেন? কেন একটা ভাঁড় হয়ে এমন নারকীয় জীবনযাপন? কেউ না কেউতো আমার হবে, কেউ না কেউতো আমার পাশে থাকবে।
ও হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন ওর পরিচিত টিবিটা আর দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে কেবলই পূর্ণিমা। বিশাল চাদ ওর মাথার ওপর নড়ছে। ও জানে না কোথায় যাচ্ছে? জানে না ঘরে না ফিরলে রাহানুম আর সুখদীপ ভাববে কি না। দুটো মানুষকে নিয়ে ও আবার একটা নতুন সংসার গড়েছে। ওদের কথা ভাবতে না চাইলেও ভাবতে হয়। আর ওরাতো ওর কথা ভাববেই। ওদের যে আর কেউ নেই। তাই ওকে ওদের ভীষণ প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন? আর কিছু না? শুধু প্রয়োজন দিয়ে কি ঘর হয়? ভালোবাসা ছাড়া? এই সব ভাবতে গেলে ওর কষ্ট বেড়ে ওঠে। ওর এখন এই সংসারের কোনোকিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। ও শুধুই একটা স্বপ্ন দেখতে চায়। জোয়ারের জলে ওর পা। ভিজে যাচ্ছে। ভেজা বালুতে পা দেবে যাচ্ছে। আর রঙিন মাছটা ওর পা বেয়ে উপরে উঠছে, উঠছে। এখন ওটা ঊরুতে এসে স্থির হয়েছে। আবুল হাশেমের দৌড়তে ইচ্ছে করে। দৌড়ে অনেকদূরে চলে যায় ও। যৌবনে বৌয়ের সঙ্গে ওর এমন একটা খেলা জমে উঠত। বৌয়ের ডান উরুতে একটা বড়ো লাল জড়ল ছিল। সেই একটি জায়গায় মুখ নেমে যেত ওর, যেমন খাবারের চাড়িতে নেমে আসে মোষের মুখ। জড়লটা যেন যম–হরণ করে নিত আবুল হাশেমের হৃৎপিণ্ড। অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে যেত ও, নিঃসাড় হয়ে আসত শরীর।