জামালকে ও অনেকদিন বলেছিল সাগর দেখাতে নিয়ে যেতে। বলেছিল, মোর সাগর দেহার বড় সাধ। দেখমু ঢেউ কেমুন গর্জন করে।
তোমার ভয় করব না?
জামালের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।
ক্যা? পানিরে ভয় কী?
জামাল বলেছিল, ঠিক আছে, একদিন তোমারে সাগরে লইয়া যামু। ঢেউয়ের মদ্যে ভাসায়ে দিমু। তখন ভয় পাইলে–কথা শেষ না করতে দিয়ে রাহানুম বলেছিল, ভয় পাইলে কী? তুমি তো লগে থাকবা। তোমারে জাপটায়ে ধইরা রাখমু।
ক্যামনে ধরবা এহন দেহাও।
ধুত, ক্যাবল শয়তানি।
হাসতে হাসতে জামাল ওকে জড়িয়ে ধরে। জামাল জড়িয়ে ধরলে ওর কাছে তা সাগরে যাওয়ার সুখ হয়ে যেত।
এখন? এখন ও বোঝে পানি কত ভয়াবহ, প্রলয়ঙ্করী, ধ্বংসকারী হয়। কে বলে পানির অপর নাম জীবন? মরণ, মরণ বলতে বলতে রাহানুম জল ছেড়ে উঠে আসতে থাকে–ভিজে শাড়ি পায়ে জড়িয়ে। যায়। ওর দৃষ্টি সৈকতে আটকে থাকে। ও বাম চোখে দেখতে থাকে পানির একটি সবুজ রেখা আকাশ ছুঁয়েছে ডান চোখে দেখে এক বিশাল বালির পাহাড় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। অনবরত বালি ঝরছে সেখান থেকে। সে বালি ধুয়ে যাচ্ছে সাগরের জলে। যেদিন সুখদীপকে পেয়েছিল সেদিনও তো এমন বালি ধুয়ে যাচ্ছিল সাগরের জলে। সুখদীপ নামটা ওর রাখা। সেদিন সুখদীপকে না পেলে ওর জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো–যেমন আবুল হাশেমের সঙ্গে দেখা না হলে। ওর শরীর থেকে জল গড়িয়ে নামে। ও আর জলের ভেতর নেই। হিংরার টুকরিটা কাঁখে তুলে নিলে ও বুঝতে পারে ওর এবার ঘরে ফেরার সময়। ঘর? ঘর মানে কী? তিনজন মানুষ এক জায়গায় হলেই কি ঘর হয়? হৃদয়ের বন্ধন কি জোড়াতালির উর্ধ্বে, নাকি জোড়াতালির মধ্যে? রাহালুমের কাছে এর কোনো নির্দিষ্ট জবাব নেই। ও হাঁটতে থাকে। চারদিক খোলা এই হা-হা করা শূন্যতায় রাহালুমের একটা পাতানো ঘর থাকলেও রাহানুম বড়ো বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে। ধুয়েমুছে গেছে ওর বাবা-মা-ভাই-বোেন, ধুয়ে মুছে গেছে শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ননদ–কিংবা ওরা কেউ কোথাও বেঁচে থাকলেও ও কারো হদিস জানে না। নিজের জীবন ছাড়া ওদের কোনো চিহ্ন নেই ওর কাছে। ওর এই নিঃসঙ্গতা কোনো আপাত নিঃসঙ্গতা নয়–এর বিস্তৃতি ব্যাপক এবং গভীর। এই গভীরতা থেকে ওর মুক্তি নেই। সৈকত পেরিয়ে আসার আগে ও একবার পেছন ফিরে তাকায়। এখানে কেবল চারদিকের সাদা আলো আর রাহানুম। আর কেউ নেই–আর কেউ কাছে এসে দাঁড়ায় না–শুধু স্বপ্নের মধ্যে রঙিন মাছটা সূচালো মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম আর একা থাকতে চায় না–চায় আর কাউকে, আর একজন মানুষ। এই সাদা আলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবনের একটা ভিন্ন স্রোত।
যে এসে বলবে, তোমার জন্য কতকাল ধরে অপেক্ষায় আছি, কেন তোমাকে খুঁজে পাই না, কেন লুকিয়ে থাকো? সেই কণ্ঠস্বর যেন উথালপাথাল করে আছড়ে পড়ছে কানের ওপর। শিরশির করে ওঠে শরীর। ও মনে মনে বলে, ক্যামনে তুমি মোরে পাইবা? মোর যে শরম করে। লোকটি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে, শরম কেন রাহনুম? আমি তোমার কতকালের চেনা–তুমি আমার সব জানো–সব। আমি তাকালে আমার চোখে তুমি বাঁধা পড়ো, আমি কাছে দাড়ালে আমার গায়ের গন্ধ তোমাকে তাড়িত করে। আমি হাত বাড়ালে তুমি বিবি হাওয়া হয়ে ছুটে এসে দু’হাত বাড়িয়ে সে হাত ধরো। আমি আর তুমি হেঁটে যাই স্বর্গীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে, পেরিয়ে যাই উদ্যানের সীমানা। পেছনে পড়ে থাকে ঈশ্বরের হাহাকার। আমরা তাকাই না, ফিরি না–আমরা পৃথিবীর। আদর্শ মানুষ হয়ে নরম মাটিতে পা রেখে ঘর গড়ি।
চেতনার পথে কত কিছু কেমন করে ঢুকে যায়–এত কিছু ভাবনা ওর করোটিতে ভেসে আসে কোথা থেকে ও জানে না–মানুষের আদিম ভাবনা বুঝি এমন–এমন। ওর মন খারাপ হয়ে গেলে হিংরার টুকরিটা অসম্ভব ভারী মনে হয়। ওই বালুভূমি ছাড়িয়ে বনভূমিতে ওঠে। পায়ের নিচে দূর্বা ঘাস, মেটো পথের দুপাশে বৈচি, বনবরই আর ভট ফুলের ঝোপ। দূরে গোল হয়ে আছে মিঠে পানির জলাভূমি, তার ওপাশে ধানক্ষেত, নারকেল গাছগুলো সবচেয়ে উঁচু হয়ে মাথা তুলে রেখেছে। প্রতিদিনের চেনা এই পথ–প্রতিদিনের আসা-যাওয়া, তবুও এই পথের দু’পাশে কোথাও একটা ছন্দ আছে, সেটা ও অন্যদিন দেখতে পায় না, আজ পাচ্ছে। আজ ওর অন্যরকম লাগছে কেন? ওর ইচ্ছে হয় একটু বসতে। মনে হয় ইচেছইতো সব–ইচ্ছেইতো মানুষকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ছুটতে বলে, বসতে বলে। খেতে বলে, ঘুমুতে বলে। ইচ্ছে না থাকলে কি চলা যায়? বেগবান হওয়া যায়? হঠাৎ করে মাথার ওপর পাখি ডেকে ওঠে। ও ওপরে তাকায়–পাখির ডাকে নিজের ইচ্ছেটাই যেন কচকচিয়ে ওঠে। রাহানুম খুশিতে চারদিক তাকায়। পাখিটা উড়তে উড়তে অনেকদূর চলে যাচ্ছে–মিলিয়ে যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে না। দেখাতো যাবেই না। সবকিছুই এক সময় না এক সময় জীবন থেকে মুছে যায়। উল্টো দিক থেকে উড়তে উড়তে আসে নতুন পাখি। ও জঙ্গলের ভেতর খানিকটা ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে। হিংরার টুকরিটা কোমর থেকে নিচে নামায়। ভারী টুকরি বহন করার ফলে কোমরে কেমন খিচ ধরে আছে। নিজেকে টানটান করার জন্য ও দু’হাত ওপরে তোলে। বাঁয়ে ঝোঁকে, ডানে ঝেকে–আড়মোড়া ভাঙে। বেশ ঝরঝরে লাগছে।
তখন ওর মনে হয় কেন কেবলই ঘরে ফেরা? কেন দেরি করলে কী হয়? সুখদীপ খিদেয় কাঁদছে? সুখদীপ ওর ছেলে–ছেলের জন্য ওর বুকে মমতা আছে। সুখদীপ কাঁদলে ওর কষ্ট হবে। তাই ওকে হিংরা সেদ্ধ করে লবণ মাখিয়ে দিতে হবে। ও খাবে। খেয়ে দেয়ে খেলতে যাবে। ছেলেকে খুশি রাখা কি মার দায়িত্ব? হয়তো তাই। রাহানুম নিজেকে বোঝায়। শুধু সুখদীপ কেন, ঘরে আবুল হাশেম আছে। তাকেও খেতে দিতে হবে। সে হিংরা সেদ্ধ খাবে না। খাবে পান্তা, সঙ্গে বাসি তরকারি কিংবা একমুঠি পোড়া মরিচ। মরিচে লাল হয়ে যাবে ভাত-ভর্তি সানকি। খেয়েদেয়ে আবুল হাশেম বেরুবে। সংসারে কত কাজ আছে সেগুলো করতে হয়। তারপর রাহানুম নিজে ভাত খাবে। খেয়েদেয়ে বড়ো করে ঢেকুর তুললে ওর মনে হয় জীবনের একটা সীমানা আছে। এপার আর ওপার। জলোচ্ছাসের সেই কালরাত সেই সীমানা টানা লাইন। মোটা দাগে টানা, মুছে ফেলা কঠিন। ঢেকুর তোলার পর কি? রাতের এঁটো বাসনকোসন-হাঁড়িপাতিল ধোওয়া, উঠোন ঝাড় দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার। করা, দুপুরের রান্নার জন্য তৈরি হওয়া? এই যদি সব হয় তাহলে কেন ঘরে ফিরবে? না, আজ ও ফিরবে না। ও একটা বড়ো গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসে থাকে। পা ছড়িয়ে দেয়, ভিজে শাড়ি গা থেকে আগলা করে পানি নিংড়ায়। ওপর থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ওর কোলের ওপর। পাতাটা নেড়েচেড়ে নিরিখ করার জন্য চোখের সামনে ধরতেই দৃষ্টি ডান এবং বাম হয়ে যায়।