ধুত না। মানহে মন্দ বলবে।
অহনতো কোনো মানু নাই। ক্যাবল তুমি আর আমি।
তবু গলা ছেড়ে গান গাইতে ওর সংকোচ হতো। একটির বেশি দুটিও কখনো গাওয়া হয়নি। হিংরা তুলতে তুলতে মুহূর্তে হাত থেমে যায়। সাগরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে, এখন জামাল কোথায়?
কিন্তু ভাবনা বেশিক্ষণ স্থিত হয় না। আবার ও ফিরে আসে নিজের বলয়ে–আবার কণ্ঠ গুনগুনিয়ে ওঠে। দ্রুত হাত চলে। প্রতিদিন ভোরবেলা সাগরে আসা হয় না। মাঝে মাঝে আসে, যেদিন করোটিতে রঙিন মাছ পাখনা মেলে ভেসে ওঠে সেদিন ও না এসে থাকতে পারে না, দেখতে চায় নিজেকে। ভোরের কুমারী আলোয় একজন কুমারী মেয়ের আকাক্ষা তীব্র হয়ে উঠলে–শরীরে রঙিন মাছ খুনসুটি করলে ও আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এই সাগর, বনানী, আকাশ এবং দিনের শুরুতে ও দেখতে পায় জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট জনপদ। আবুল হাশেমের সংসারে স্থিত হওয়ার পর ও আবুল হাশেমকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নিজের গ্রামে, কিন্তু না সেখানে গ্রামের কোনো চিহ্ন নেই–একজন মানুষ, একটি ছাগল, একটি হাঁস কিংবা একটি গাছ কিছুই, কেবল খাঁ-খাঁ শূন্যতা, ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া সাদা মাটি। সেই শূন্যতায় কেমন অবশ হয়ে গিয়েছিল ওর চিন্তাশক্তি এমন করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি গাঁ? একফোঁটা চিহ্নও পেছনে ফেলে রাখবে না? ও ভাবতে পারে না। ফলে ওর কান্না আসে না, দুঃখও হয় না–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। একসময়ে আবুল হাশেম ওর হাত ধরে বলে, চল মা?
ও আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোমনে?
ক্যা মোর ঘরে?
আমনেহর ঘর?
তখন ওর সামনে ঘর ছিল না, ভিটেও না। দৃষ্টিতে শূন্যতায় বাধা পায় না। যতদূর চোখ যায় ঘর কোথায়? সে সময়ে ওর কোলে সুখদীপ কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই শূন্যতায় শিশুর কান্না জীবনের প্রবাহ ফিরিয়ে আনে। ও সুখদীপকে ঘাড়ের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে কান্না থামাতে চায়। তারপর আবুল হাশেমের দিকে ফিরে বলে, বাবো, চলেন, আমনের ঘরে যাই।
তারপর ভেবেছিল জামাল বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওকে খুঁজতে আসবে। আবুল হাশেমও ওকে এমন আশ্বাসই দিয়েছিল। ও আশায় আশায় দিন গুনেছে। কই এলো না তো, প্রতীক্ষার প্রহরই শেষ। সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কোনো ইঞ্জিন নৌকা কিংবা ট্রলারের আশায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে একটি মানুষের বিন্দু থেকে বৃহৎ হয়ে ওঠার আশায়, কিন্তু সবটাই অলীক, বৃথাই কেটে গেল কতগুলো বছর। সাগর যদি তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে ওঠে, বাঁচতে পারে না অনেকে, যেমন মণিমালারা কিংবা জামালরা। শুধু আবুল হাশেমরা, রাহনুমরা বেঁচে থাকে আর একটি ঘর গড়ে তোলার আশায়। এবং সেই সঙ্গে একটি শিশুও। ওহ্ একটি শিশু! সেদিন দুধের ভারে কী বিশালকায় হয়ে উঠেছিল ওর স্তন। কী অপার আনন্দ ছিল একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে। আজ? আজ রাহানুম অন্যকিছু চায়–অন্য স্পর্শ, একটি হাত, একজোড়া ঠোঁট, গভীর নিঃশ্বাস। রাহামের সর্বাঙ্গে রঙিন মাছটা উঠে আসে–সোনালি শরীরের মাছে কালো ফোঁটা। সূঁচালো ঠোঁট। মাছের সুঁচালো ঠোঁট ওর শরীরে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম ব্রিত বোধ করে। ও হিংরার টুকরি রেখে আবার নেমে আসে জলে। পায়ের পাতার সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। হাঁটু সমান জল–সেখানে মাছের ঠোঁট। কোমর সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। বুক সমান জল, মাছের সঁচালো ঠোঠের ওপর বুক কাঁপে–কেঁপে কেঁপে এলিয়ে পড়ে, আলুথালু হয়ে যায়, অগোছালো হয়ে যায়–সাগরের তিরিশ ফুট ফুলে-ফেঁপে ওঠার মতো স্বাভাবিক, উন্মত্ত এবং গর্জমান হয়ে যায়। তখন স্রোতে ওর শাড়ি ভেসে গেলে ও নিজেই একটা রঙিন মাছ হয়ে যায়–স্বপ্নের, যন্ত্রণার এবং আগামী দিনের। রাহানুমের কান্না পায়। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে সাগরে এসে এই সুখ মেটানোর দায় থেকে ও নিজেকে মুক্ত করতে চায়। কেবলই ভাবে, এভাবে নয়, এভাবে নয়। এই নগ্ন শরীর নিয়ে ও কী করবে? ওর তো কিছু চাওয়া আছে।
তখনো সূর্য ওঠেনি। আকাশ লাল হয়েছে মাত্র। ও দু’চোখ মেলে দিগন্ত দেখে। এভাবেই তো বিশাল হওয়া–এভাবেই তো শুরু, এভাবেই। প্রথমে নীল ছিল আকাশ, তারপর সাদা হলো, তারপর লাল–রাহানুম নিজের মনে জোর খোঁজে এই ভেবে যে শুধু আকাশ বদলাবে কেন? কেন রূপান্তর সর্বত্র নয়? কেন নিজের মধ্যে নয়? যৌবনটা নীল ছিল, জামালের সঙ্গ-সুখ ছিল, মাতৃত্বের স্বাদ ছিল–সন্তানের আনন্দ–সবকিছু মুছে গিয়ে কেমন সাদা হয়ে গেল দিনগুলো, কত আর অপেক্ষা, কত? কোথাও থেকে তো জামাল আসে না–না সাগর থেকে, না বনভূমি থেকে, যেমন অনেক সময় অকস্মাৎ ফিরে আসত মাছ ধরা ফেলে রেখে, তখন ওর মধ্যে ঘরের টান প্রবল হয়ে উঠত–রাতগুলো হয়ে যেত নির্মল সাদা মেঘ। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দুজনে বসে থাকত পুকুরপাড়ে, মাথার ওপর শ্যামকুঁকড়ার ডাক। একটি নির্দিষ্ট গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকলে সেই মাথা দূর থেকে ক্রমাগত কাছে চলে আসত। একদম সামনে, একটি নকশিকাঁথার নকশা হয়ে–চিত্রিত ফুল বা হাঁড়ি, গাছ বা হরিণ–যেমন ঘন বন গজিয়ে উঠেছে ফাতরার চরে তেমন বন গজিয়ে ওঠে রাহালুমের চোখের সামনে। কোনো একটি জিনিস কাছে চলে এলে তখন ওর দুচোখের দৃষ্টি একসঙ্গে কাজ করে না। ডান চোখ দিয়ে তাকালে বাম চোখ সরে যায়, বাম চোখ দিয়ে তাকালে ডান চোখ। তখন আন্ধারমানিক নদী ওর মাথার মধ্যে খেলা করে–দৃষ্টির রেখা নদীর জল হয়ে সাগরের দিকে ছোটে।