উল্টো দিকে আসতেই দেখে ট্রলারের ফাঁকে একজোড়া নারকেল আটকে আছে। ও খুশি হয়ে যায়। এখন ওদের কিছু খাবার দরকার, নইলে শক্তি ফুরিয়ে আসছে। ও ট্রলারের গায়ে পিটিয়ে নারকেল ভাঙে। দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে কয়েক টুকরো বের করে। ট্রলারের ওপর থেকে রাহামের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ল মা খা।
কি যে ভোখ লাগছিল মাগো। আমনহে না থাকলে কে মোরে খান দিত বাবো?
রাহানুমের কৃতজ্ঞ কণ্ঠ শুনে আবুল হাশেমের বুক জুড়িয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না। একটু পরপর নারকেলের টুকরো রাহামের হাতে তুলে দেয়। রাহানুম কুটকুট শব্দে নারকেল চিবোয়। দুজনে। অনেকক্ষণ ধরে একজোড়া নারকেল খেয়ে ফেলে।
পেটপুরে খেয়ে শিশুটি ওর নতুন মার কোলে ঘুমিয়ে আছে। ওর জন্য নিরাপদ, নিশ্চিত আশ্রয়। ট্রলারের পাটাতনে আবুল হাশেম চিৎপাত শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম নেই। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। অসংখ্য জ্বলজ্বলে তারা ভোরের শিউলির মতো ছড়িয়ে আছে। সেই শৈশবে শিউলি-কুড়োনোর দিন ছিল ওর জীবনে, স্মৃতির ভেতরে তারার মতো ফুটে আছে তা। সেই দিনগুলো কখনো মিথ্যে হয়ে যায় না, সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ড়ুবে থাকে। সময়ের ভাজ পড়ে সময়ের ওপর–এভাবেইতো এগিয়ে যায় জীবন
ও খুব কোমল কণ্ঠে রাহামকে ডাকে, রাহনুম? মাগো? সাড়া নেই। হয়তো ট্রলারের গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রাহামের কাছ থেকে ওর কথা শুনতে চেয়েছিল আবুল হাশেম। কেমন সময় ওর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা জানার বড় সাধ হয়। কিন্তু না, ওর ঘুম আর ভাঙাতে চায় না। ও অবাক হয় এই ভেবে যে এই মেয়েটি কত সহজে ওর কাছাকাছি চলে এসেছে–কত সহজে একটি শিশুর মা হয়েছে। সবইতো সেই জীবনের ধারাবাহিকতা যে জীবনের কোনোকিছু হারিয়ে যায় না। স্মৃতির ভাজে জড়িয়ে থাকে সেইসব দিন। শুধু প্রয়োজন মানুষকে বদলে দেয় খানিকটুকু।
আবুল হাশেম ঘুমহীন চোখে দেখে আকাশে নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ ছায়াপথ, অজবীথি, এক মহাবিশ্ব। এইসব নিয়ে এতদিনের জীবন হারিয়ে আর এক জীবন গড়ে ওঠে। এইসব দিয়ে মানুষ, মানুষ থেকে। মানুষের ভেতর চলে যায়।
এভাবেই তিনজন মানুষের ঘর-সংসার আবার গড়ে ওঠে।
০২. তখনো অন্ধকার ভালো করে কাটেনি
তখনো অন্ধকার ভালো করে কাটেনি। রাহানুম দ্রুত পায়ে নিঃশব্দে সাগরের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। দেখে এসেছে নিঃসাড় ঘুমচ্ছে আবুল হাশেম। সুখদীপ ওর গলা জড়িয়ে রেখেছিল। রাহানুম হাত ছাড়িয়ে উঠে এসেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুমের আমেজ কেটে যায়। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে গড়িয়ে যাচ্ছে সৈকতে।
এ সময়ে এভাবে সাগরের পাড়ে ছুটে আসা ওর এক প্রিয় অভ্যেস হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলে জোর করে আর চোখের পাতা বুজে রাখতে পারে না–তোলপাড় করে বুক; মন খারাপ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে, তখন ও ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে ছুটে আসে। ও জানে এই ছুটে আসা ওর মুক্তি–নইলে ভেতরটা গুড়িয়ে যেতে থাকে। এই অভ্যেস ওর এই নতুন জীবনের–আগে ও কখনো সাগর দেখেনি। সাগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল ওদের গ্রাম–এভাবে চাইলেই ছুটে যেতে পারত না। এখন সাগর এত আপন হয়েছে যে বিশ বছর ও সাগর
দেখে কাটিয়েছে, এটা ওর মনেই হয় না। এই আপন হয়ে ওঠা ওর এক দারুণ অভিজ্ঞতা–ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে অবিরত দুঃখের দংশন থেকে। ও জলের ভেতর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নিজেকে উজাড় করে। ফেলে।
আজো রাহানুম এক পা, দু’পা করে পানিতে নামে। আজ আর ঝাপিয়ে পড়ে না ও। একটু একটু করে পানির সঙ্গসুখ অনুভব করতে চায়। ও এভাবেই উপভোগ করে। প্রতিদিন একইভাবে নিজেকে উজাড় করে না। একটু একটু করে এগুতে ওর মনে হয় যতই পানির স্পর্শ বাড়ে ততই শিরশির করে শরীর। বিশ বছর বয়সে মা হয়েছিল ও, বিয়ে হয়েছিল আঠারোতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো ভেঙে গেল সব। ঢেউ ওর গলা সমান হয়েছে, আর একটা ঢেউ এলে তলিয়ে যাবে ও। তারপর ভুস করে মাথা জাগিয়ে উঠবে।
কিন্তু গলা সমান পানি থেকে ও আবার তীরের দিকে যায়, এত তাড়াতাড়ি ড়ুবতে চায় না। এটুকুই ওর মজা, এক ধরনের সুখ। অনেকটা যৌন সুখের মতো, বিয়ের পরই যে অনুভূতি ওকে আচমকা ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল। এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল ওর। এখন মনে হয় বিশ বছর বয়সে একজন নারীর জীবন থেকে পুরুষ হারিয়ে গেলে হয়তো এমনই হতে পারে। ও জানে না এমন হয় কি না, ও বোঝে না এমন হওয়া উচিত কি না। শুধু ওর জীবনে এটুকু কি সম্পদ হয়ে থাকবে? অনুভূতির সম্পদ? ও বিড়বিড়িয়ে বলে, থাকুক, থাকুক।
শাড়িটা ওর গায়ে লেপ্টে গেছে। আলো ফুটলে ও নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। দিনের প্রথম আলোতে নিজেকে দেখাটা ওর আনন্দ। কোথাও কেউ নেই, এ সময় কেউ থাকে না। তাই নিজেকে ছড়িয়ে রাখার এই জায়গাটা ওর আপন ঘরের কোণের মতোই লাগে–মনে হয় না এই খোলামেলা বিশাল চারপাশ অন্যদেরও, সবার। ও সৈকতে উঠে আসে। স্রোতে ভেসে আসা হিংরা কুড়ানোর জন্য ও বালুর ওপর হাঁটু গেড়ে বসে। রোদ উঠলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হিংরা কুড়ানোর জন্য ছুটে আসবে। এক একজন প্রায় ছোটখাটো এক ঝুড়ি হিংরা সংগ্রহ করতে পারে। রাহানুমও একটা টুকরি নিয়ে এসেছে। ও খুঁজে খুঁজে হিংরা তোলে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। এই গানটা জামালের খুব প্রিয় ছিল। অন্ধকারে পুকুরপাড়ে দুজনে বসলে জামাল ওকে গান গাইতে বলত। ও চাপাস্বরে গাইত। ভয় ছিল পাছে বাড়ির লোকেরা শুনে ফেলে। জামাল ওর কণ্ঠে অভিভূত হয়ে বলত, আহা কী মিষ্টি গলা! আর একড়া গান গাও ময়না।