আবুল হাশেম ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, মুইও আর আঁটতে পারি না। পাও চলে না।
মোরা ওই ট্রলারটার ধারে বমু।
চলেন ওইহানে যাই।
রাহানুম উৎসাহী কণ্ঠে কথা বলে। ওর ভেতরে জোর ফিরে এসেছে। বাঁচার তাগাদা প্রবল হচ্ছে। এখন ওর একটি আশ্রয় দরকার। ও একজন বাবা পেয়েছে, এখন একটি ঘর পেলে ও হয়তো টিকে যাবে। টিকে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে ওর অন্য চিন্তা নেই। আবুল হাশেম বুঝতে পারে বয়সের তারুণ্য ওর ভেতরে দ্রুত শক্তি সঞ্চারিত করেছে। তাই বালুর ওপর দিয়ে বেশ শক্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রাহানুম। আবুল হাশেম বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। ধকলের ক্লান্তি ও কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
দুজনে ভাঙা ট্রলারের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় শিশুর কান্না। কী করে সম্ভব? চমকে ওঠে রাহানুম। ওর শরীর কেঁপে ওঠে। থমকে দাঁড়িয়ে আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্ত মাত্র। তারপর সেই কান্না লক্ষ্য করে ছুট লাগায়। কিছুদূর ছুটে এসে রাহানুম থেমে যায়। দেখতে পায় ছোটার ফলে ওর স্তন থেকে দুধ ঝরছে, ভিজে গেছে শাড়ি। এই দৃশ্য ওকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। ও ছুটতে ছুটতে ভাঙা ট্রলারটার কাছে এসে দাঁড়ায়। শিশুটি ট্রলারের নিচে বসে আছে। হয়তো বছর দুয়েক বয়স হবে। কীভাবে বেঁচে গেল ও? রাহানুম শিশুটির সামনে হুমড়ি খেয়ে বসতে বসতে ভাবে, আল্লাহ বুঝি এমনই দয়ার সাগর। ওর মনে হয় শুধু ওরই জন্য এই শিশুটি এখানে বেঁচে আছে। এই অলৌকিকতা কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। কৃতজ্ঞতায় ও অভিভূত হয়ে যায়। ওর বুকের ভেতরের তোলপাড় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের চাইতেও বিশাল হয়ে ওঠে। ও ক্ষিপ্র হাতে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আদরে আদরে ওকে পিষ্ট করে। তিন মাস আগে ও মা হয়েছিল, ওর প্রথম সন্তান।
শিশুটি পাগলের মতো ওর বুকে মুখ ঘষে। রাহানুম বুঝতে পারে ওর স্তন নির্গমন চায়, যেটুকু তরল পদার্থ ঝরেছে সেটুকুই যথেষ্ট নয়, আরো ঝরবে, আরো। শিশুটি অস্থির হয়ে উঠেছে। ও আশ্রয় চায়, খাবার চায়। যদিও কান্না ছাড়া এখন ওর আর কোনো ভাষা নেই, তবুও এখন কান্না বন্ধ। ও একবার দুহাতে রাহামের গলা জড়িয়ে ধরে। একবার কাঁধ খামচে দেয়, আর একবার গালে গাল ঘষে। ও কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর ক্ষুদ্র হাত রাহামের শরীরের কোনো একটি জায়গায় পৌঁছতে চায়, কারণ ও মায়ের স্তন পান করেছে। ও জানে যে স্বাদ কী। যে স্বাদের জন্য ওর জিহ্বা তীক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঈপ্সিত জিনিস ও পাচ্ছে না। কেউ ওকে সাহায্য করছে না। কোনো কিছু করতে না পেরে শিশুটি আবার ভঁা করে কেঁদে ফেলে। ওর চিৎকারে রাহামের শ্রবণশক্তি যেন বধির হয়ে যায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কেন এই মানব শিশুকে অকারণ কষ্ট দেওয়া? ও শিশুটিকে কাঁধের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে দিতে চাইলে শিশুটি প্রতিবাদ করে। হাত-পাত ছুঁড়ে চিৎকার করে কোল থেকে নেমে যেতে চায়।
তখন রাহানুম ট্রলারের ভাঙা কাঠের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে দেয়। শিশুটি ওর কোলে। বেশ খানিকটা তফাৎ থেকে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে। ও রাহামের মতো ছুটতে পারেনি। ছুটলে বুকে হাঁফ ধরে, বয়স ওকে জাপটে ধরেছে। রাহানুম বুঝতে পারে যে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে, কিন্তু ও পুরো একজন মানুষকে দেখতে পায় না। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাহানুম বুকের কাপড় সরিয়ে শিশুটির মুখে নিজের স্তন তুলে দেয়। ওহ্ কী আনন্দ! কী আশ্চর্য সুন্দর সন্ধ্যার এই নেমে আসা। রাহানুম দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। অনেকদূরে বনভূমির মাথায় যে অন্ধকার নেমেছে তা অস্পষ্ট নয়, গাঢ়–তবু সেখানে আলো দেখতে পায় রাহানুম। পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে। আলো, প্রশাখার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় আলো–কাণ্ডের ভেতর দিয়ে শেকড়ে পৌঁছে যায় সে আলো। রাহানুম চোখ বুজতে পারে না–চোখের পাতা পড়ে না। ওর মাথায় স্বপ্ন ঘনিয়ে ওঠে–সে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আলোর নদী বয়ে যায়। ও বুঝে যায় এই মহাপ্রলয়ের পর জীবনের এইটুকু সুখ ওর পাওনা ছিল।
আবুল হাশেম ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে দেখতে পায় এক অলৌকিক স্বর্গীয় দৃশ্য। রাহালুমের উন্মুক্ত বুকে এক মানব শিশু। শিশুটিকে নিয়ে ও মগ্ন হয়ে আছে। ওর কোনোদিকে খেয়াল নেই। এই পৃথিবী ওর কাছে। অবলুপ্ত হয়েছে, গতরাতের জলোচ্ছ্বাস এখন আর ওর জীবনে মহাপ্রলয় নয়। ও জানে ও একজন মানবী–ও প্রকৃতি–শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা ওর ধর্ম।
এই দৃশ্য দেখে আবুল হাশেমের বুক ভরে যায়, প্রচণ্ড তৃপ্তি ওকে আচ্ছন্ন করে। ওদের প্রথম সন্তান হবার পর মণিমালাকেও এমনই লাগছিল–প্রকৃতির মতো জীবনদায়িনী, যাদের ক্রোড়স্পর্শ না পেলে বন্ধ হয়ে যেত মানবজাতির ধারাবাহিকতা। এখন অন্ধকার বলে রাহানুমের মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না, তবু সে মুখে জ্যোতি আছে, আবুল হাশেমের এটা অনুভব। তখন মণিমালাকে দেখতে ওর ভালো লাগত, নতুন মনে হতো, কেমন জানি অন্যরকম। মণিমালার চেহারায় আলোর জ্যোতি খেলত। মণিমালা লজ্জা পেয়ে বলত, এমন করে তাকিয়ে থাহেন ক্যা?
আবুল হাশেম মাথা নেড়ে বলত, কী জানি ক্যা।
উত্তরটা ওর নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। আবুল হাশেমের অন্যমনস্ক মাথা নাড়া দেখে মণিমালা ছেলেকে শাড়ির আঁচলের নিচে আড়াল করে বলত, আমনেহ তাকায়ে থাকলে পোলাডার যদি কিছু অয়?
ওই কথা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেত আবুল হাশেম। অপরাধীর মতো দ্রুত সরে যেত মা ও ছেলের সামনে থেকে। এই কথা মনে করেই ও ভাঙা ট্রলারের উল্টোদিকে চলে যায়। ওর তাকিয়ে থাকা দিয়ে ও কারো ক্ষতি করতে চায় না, আর কোনো ওলটপালট নয়। এখন এক দারুণ সময়। প্রত্যেকেই নতুন জীবনের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছে। আবুল হাশেমের করোটিতে বানের পানি পলিমাটি ফেলে। যেন বলছে, শুভযাত্রা হোক, শুভযাত্রা। এই সময়, এই অন্ধকার ওর ভালোই লাগছে।