সাড়া নেই। ঘুরেও তাকায় না। দূর সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হয় ও ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ও ভাঙবে, গড়বে কিংবা ইস্পাতের মতো কঠিন হবে–এই ভাঙচুরের সময় বড়ো কঠিন সময়। মানুষ যখন কঠিন সময় পার হয় তখন পারিপার্শ্বিকের সবকিছু ভুলে যায়–ওর সামনে বড়ো কিছুই প্রবল হয়ে ওঠে, সেটা সমুদ্র কিংবা আকাশ। আবুল হাশেমের ইচ্ছে করে রাহানুমকে ধরে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে। দেখতে চায় মেয়েটি কি মাটির সঙ্গে গেঁথে শিলা হয়ে গেছে না কি ওর মধ্যে প্রাণ আছে? কিন্তু কিছুই করা হয় না। কিছু করতে ভয় পায় ও। আবুল হাশেম বুঝতে পারে রাহানুম আছে বলে ওর অবসন্নতা কেটে যাচ্ছে। ওর ভালো লাগছে–এবং বুকের। ভেতর পাখির ডাক শোনার যে ব্যাকুলতা ছিল তেমন একটি শিস বাড়ছে। ওর ভালো লাগছে।
ও আস্তে আস্তে আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী মাগো?
রাহানুম জবাব দেয় না। শুধু ওর দিকে তাকায়। আবুল হাশেম ভাবে, এই ট্রলারটিকে মেয়েটি হয়তো একটি আশ্রয় ভেবেছে–একটি ঘর কিংবা গাছের ছায়া। তখন ও বিড়বিড় করে কী যেন বলে আবুল হাশেম বুঝতে পারে না। কিন্তু ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এই মরা মেয়েটি বেঁচে আছে? কিন্তু ওর কণ্ঠে আর্তনাদ নেই কেন? ও বিলাপ করছে না কেন? বিলাপের কথা মনে করতেই ওর বুকটা আবার কেমন হয়ে যায়। ও দুর্বল কণ্ঠে রাহানুমকে বলে, তোমার বাড়ি কোমনে মাগো?
রাহানুম এবারও উত্তর দেয় না। ও কিছুই মনে করতে পারছে না। ও বারবার হাত বাড়ায়, তারপর শূন্য হাত ফিরিয়ে আনে নিজের কোলের ওপর। আবুল হাশেমের ভেতরে ভেতরে জেদ বাড়ে। মেয়েটি কথা বলছে না কেন? কথা বলবে না কেন? ও ওকে আবার একই প্রশ্ন করে। ও তেমনি নির্বিকার। আর কোনো কথা হয় না। ও ট্রলারের ওপর থেকে নেমে পড়ে। খানিকটুকু সামনে হেঁটে আসে। কিন্তু রাহানুমকে ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। ফিরে এসে ট্রলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরুপায় ক্ষোভ নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ভাটি। সরসরিয়ে নেমে যাচ্ছে জল। আবুল হাশেমের মাথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। ঘোর কেটে যাচ্ছে। ও পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে। এখন কী করবে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েটি বারবার হাত বাড়ায় কেন? ও কাকে খোজে? কোন গ্রামের মেয়ে। বাবা কে? স্বামী কি ছিল? কিন্তু ওকে প্রশ্ন করে কী লাভ? ওতো উত্তর দেয় না। আহা বেচারি। ভাবতেই আবুল হাশেম নিজের পরিবারের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন ওর কান্না পায়। ও শব্দ ক করে কেঁদে ওঠে।
কান্নার শব্দে রাহানুম আবুল হাশেমের দিকে ফিরে তাকায়। ওর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা মানুষটি যেন আপন নিয়মে ফিরে এসেছে। আবুল হাশেম অনুভব করে যে ওর চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে। আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই ও মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, না, মনু না, কাঁদে না। গেদু মোর, কাঁদে না।
আবুল হাশেম কেঁদে কেটে লুঙ্গি দিয়ে চোখ মোছে। তখন রাহানুম। আস্তে আস্তে বলে, কান্দেন ক্যান?
তুমি কান্দ ক্যান?
মোর গেদু? মোর গেদু কোমর্নে? ও মাগো–
রাহানুম এতক্ষণে তারস্বরে চিৎকার করে। বিলাপ করে, ও মোর গেদুরে তুই অহন কোমনে? বানের সময় তুইতো মোর বুকের মইদ্যে ছিলি। ওহ্ হোরে ..
রাহানুমের কান্নার একটা ঢঙ আছে। সেটা অনেকক্ষণ রেশ জাগিয়ে রাখে। সেই শব্দে বিভিন্ন রকম ওঠানামা আছে। আবুল হাশেম কান পেতে শোনে। এই শোনার অভিজ্ঞতা ওর একদম নতুন। ও কখনো এমন শব্দের কান্না শোনেনি। এমন ঘটনাতো ওর জীবনে ঘটেও নি। ও কী করে জানবে যে কান্নার এমন হাজার রকম শব্দ আছে। নিজের কান্নাতো এমন কান পেতে শোনা যায় না। শোনা গেলে বুঝতে পারত কান্নার ওঠানামা কীভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে। সে শব্দ অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালে বুকটা হু-হু করে ওঠে। মণিমালা কোথায়? ও কি কোথাও বসে এমন করে কাঁদছে? মণিমালার বিলাপ আবুল হাশেমকে কখনো শুনতে হয়নি। ও কি সেজন্য ভাগ্যবান? হ্যাঁ, ভাগ্যবান, ভীষণ ভাগ্যবান। তাই এই কান্না ও শুনতে চায় না। রাহানুম কাঁদতেই থাকে। ও এই কান্নার শব্দ থেকে দূরে চলে যাবার জন্য উঠে হাঁটতে থাকে। দ্রুত পায়েই হাঁটে। তখন রাহানুম চিৎকার করে ওর পিছে ছুটে আসে, ও বাবা আমনহে কোমনে যান? মুই আমনহের লগে যামু?
আবুল হাশেম থমকে যায়। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কে ওকে এমন ব্যাকুল স্বরে বাবা বলে ডাকছে? মেয়েটি তো ওর আত্মজা নয়। তবে ও কে? কে ও? এ কেমন সম্পর্ক মানুষের মধ্যে? কী করে গড়ে ওঠে? আবুল হাশেম স্নেহের ব্যাকুলতায় রাহামের হাত ধরে। ততক্ষণে ওর ফোঁসফোসানি কমেছে। হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়ে আসছে। দৃষ্টি শান্ত, স্পষ্ট। এতক্ষণে ওকে স্বাভাবিক মানবী মনে হচ্ছে।
আবুল হাশেম ওর চোখে চোখ রেখে বলে, মাগো, মুইওতো জানি যে মুই কই যামু? লও, তুমি মোর লগে লও।
তখন সূর্য পশ্চিমে, লাল আভায় লাল হয়ে গেছে দিগন্ত। ভাটির টান শেষ হয়নি। দুজনে কোনো কিছু স্থির করতে না পেরে পশ্চিমমুখো হাঁটতে থাকে। ভাবে যেদিকে আলো সেদিকেই হয়তো ঘর থাকে–মানুষ থাকে, লোকালয় থাকে। কতদূর যেতে হবে? ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে পা চলে না। তবু ওরা থামবে না বলেই ঠিক করে। কতদূর হেঁটেছে জানে না–কতদূর যাবে জানে না। বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। প্রশান্ত সাগরে দিনের শেষ আভা। ওরা দেখতে প্রায় খানিকটা দূরে আরো একটা ভাঙা ট্রলার উল্টে আছে। রাহানুম আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়, বাবো, আর আঁটতে পারমু না।