এসো।
আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে ওদের ডাকেন।
ওরা কাছে এলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখেন। পরস্পরের বুকের উষ্ণতায় নির্ভরতা বাড়ে। আকমল হোসেন ওদের মাথার ওপর মুখ রেখে চোখ বন্ধ করেন।
তারপর ছেলেরা বলে, আমরা যাই, আঙ্কেল।
এসো। দোয়া করি, সফল হও।
যোলো পাউন্ড পিকে বহন করার আগেই সমস্যা দেখা দেয়। মাহবুব ওদের খবর দেয় যে, সাততলার যে ঘরে পিকে রাখা হয়েছে, সে ঘরের ফাইলপত্র গোছানোর তোড়জোড় চলছে। দুই কিশোর যোদ্ধা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। যোলো পাউন্ড পিকে বহন করার আগেই কাজটি করে ফেলতে হবে।
মাহবুবের পায়ের নকল ব্যান্ডেজের নিচে বেঁধে দেওয়া হয় ছয় গজ ফিউজওয়্যার। একটি কলমের ভেতরের অংশ ফেলে দিয়ে খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি ডেটোনেটর। মাহবুব সেগুলো পায়ে বেঁধে ঢুকে যান অফিসে।
জন আর ফেরদৌসের জন্য দুটো পাস জোগাড় করা হয়েছিল। অডিশন দেওয়ার অজুহাত ছিল। ওরা নির্দিষ্ট সময়ে ডিআইটি ভবনে ঢুকে যায়। ছয়তলার চেকপোেস্ট পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ওঠে। সাততলার গেটে পুলিশ ওদের আটকায়। কী জন্য যাবে, জিজ্ঞেস করতেই ওরা বলে, ওরা সরকারের অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে বুড়িগঙ্গায় কতটা পানি বেড়েছে, তা দেখার জন্য। এবারে বর্ষা খুব বেশি। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওদের কথার মাঝখানে অন্য লোকজন এসে পড়ায় পুলিশ ওদের ছেড়ে দেয়।
ওরা দ্রুত উঠে যায় নির্দিষ্ট ঘরে। পিকে বের করে একত্র করে। জন চার্জ সেট করে। ফিউজওয়্যারে ইগনিশন পয়েন্ট ও ডেটোনেটর ফিট করে ফেরদৌস।
ওদের সামনে সময় অনন্তকাল। অথচ মুহূর্ত মাত্র সময়। বেলা একটা বারো মিনিটে ফিউজওয়্যারে আগুন দেয় ওরা।
হাতে মাত্র তিন মিনিট সময়। তিন মিনিট পর বিস্ফোরণ ঘটবে। সরে যেতে হবে এই ভবনের এলাকা থেকে। ওরা যখন ভবন ছেড়ে রাস্তায় নামে, তখন বিস্ফোরণ ঘটে।
গাড়ি নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন আকমল হোসেন। বিভিন্ন দোকানে ঘুরে নানা জিনিস দেখছিলেন। টুকটাক কেনাকাটাও করেছেন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে গাড়ির কাছে আসেন। ওদের দূর থেকে দেখে গাড়িতে স্টার্ট দেন। ওরা এসে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে শুরু করে।
কনগ্রাচুলেশনস, ফ্রিডম ফাইটার্স।
আকমল হোসেন রাস্তার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন।
আমার বুক এবং পিঠ দুটোই তোমাদের জন্য আছে। আমার পিঠ দেখে ভেবো না যে, আমি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছি।
হা হা করে হাসে দুই ছেলে।
আমরা তো সবই জানি, আপনি আমাদের অভিভাবক, আঙ্কেল।
তোমাদের কোথায় নামাব?
মগবাজারের কোথাও।
ঠিক আছে। এই সময় আমি বাইরে থাকতে চাই না। বাড়িতে খোঁজ নিতে আসতে পারে বিস্ফোরণের ঘটনায়। ওরা দেখুক যে আমি বাড়িতেই আছি। ওদের কোনো প্রশ্নের সুযোগ দেব না। যা করবে, আমার ওপর দিয়ে করবে। গাড়ি থামে মগবাজারের মোড়ে। দুজনে নেমে যায়।
বাড়ি পৌঁছে আমাকে একটা ফোন দিয়ো তোমরা।
জি, আঙ্কেল।
ওরা দ্রুত পায়ে গলির ভেতর ঢুকে পড়ে।
আকমল হোসেন বাড়ি ফিরলে দেখতে পান, আয়শা খাতুন বারান্দায় বসে আছেন। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে মনে হয়। মাথার সামনের দিকের অনেক চুল সাদা হয়েছে। আকমল হোসেন গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাতে গেলে পেছনের বারান্দায় আসেন আয়শা খাতুন। তিনি বারান্দায় উঠলে বলেন, সাকসেসফুল অপারেশন?
হ্যাঁ।
ওদের বাড়িতে দিয়ে এসেছ?
না। মগবাজারের মোড়ে ছেড়ে এসেছি। ভাবলাম, আমার বাড়িতে থাকা দরকার। যদি আর্মি খুঁজতে আসে।
যদিও সেদিনের পর আর্মি এ বাড়িতে আসেনি। তারপর বলা তো যায় না।
ঠিক বলেছ, আশা।
তোমার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে রেখেছি।
লেবুর শরবত! চমকে ওঠেন আকমল হোসেন। হঠাৎ করে মনে হয়, কথাটি তাকে মেরিনা বলল। ঠিক যেমন করে মেরিনা বলত, ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই আয়শা বলেছে। তিনি আয়শার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ান। ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, এসো। লেবুর শরবত খাবে। যা গরম পড়েছে। ভীষণ ভাপসা গরম।
আয়শা ফ্রিজ থেকে লেবুর শরবত বের করেন। নিজের জন্যও এক গ্লাস। দুহাতে দু-গ্লাস নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন। গ্লাস নিতে নিতে আকমল হোসেন জিজ্ঞেস করেন, কী রান্না হয়েছে?
পাবদা মাছের ঝোল। করল্লা ভাজি আর ডাল। আর কিছু চাও?
না, না, এতেই হবে।
ভাত তো খেতেই পারো না। ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে থাকো। মনে হয়, ভাত খেতে তোমার বুঝি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কেউ ভাত খায় না।
ঠিকই বলেছ। তবে ঠিক বলেনি যে, এভাবে কেউ ভাত খায় না।
ঠিক বলিনি? আমি ঠিকই বলেছি।
আমি তো জানি, আরও একজন এভাবেই ভাত খায়। আমারই সামনে বসে খায়।
আয়শা খাতুন লেবুর শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে উঠে পড়েন।
বসো, আশা। তুমি শরবত না খেলে আমিও খেতে পারব না।
আয়শা খাতুন সোফায় এসে বসেন। দুজনে একসঙ্গে একটু একটু করে শরবত খান। যেন একেকটি চুমুকে শেষ হয়ে যেতে পারে জীবনের বাকি সময়টুকু।
মন্টুর মা দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, টেবিলে খাবার দিয়েছি।
দুজনে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকান। যেন বলতে চান, তুমি আমাদের নীরবতা কেন ভাঙতে এসেছ। কিন্তু বলা হয় না।
ঘুমোতে যাবার আগে ফোন আসে জনের কাছ থেকে।
আঙ্কেল, মাহবুব ভাই জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে টাওয়ারের একটি অংশে ফোকর হয়েছে। সাততলার মেঝেতে গর্ত হয়েছে। আগুন সাততলা থেকে ছয়তলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অফিসের অনেক কাগজপত্র পুড়ে গেছে।