চা খেতে খেতে আয়শাকে বললেন, দু-এক দিনের মধ্যে ছেলেরা গেরিলা পত্রিকা বিলি করার জন্য নিয়ে আসবে। ফোনে তা-ই বলল।
আসুক। যত খুশি কপি পারে নিয়ে আসুক।
কে বিলি করবে?
কেন, আমি। তুমিও করবে। আলতাফ করবে।
আয়শা খাতুন চায়ের কাঁপে চুমুক দেন। আকমল হোসেনের দিকে তাকান না। আয়শা খাতুনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করলেন আকমল হোসেন। তিনি নিজেও শেষ করে কাপটা ঠেলে দিলেন। দেখলেন, আয়শা খাতুন চামচ দিয়ে পিরিচে টুংটুং শব্দ করছেন। একপর্যায়ে বলেন, বল, কী বলবি? ভাবছিস, কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেই আমি তোর কথা বুঝব? পেটে ধরেছি বলে এমন করে ভাবতে হবে?
আমার গানটি আপনার কাছ থেকে শুনব, আম্মা। মনে হচ্ছে, এখনই আমার গান শোনার সময়।
তোর প্রিয় গানটি, মা? আমার ময়না পাখি।
তুমি কি কিছু ভাবছ, আশা?
ভাবছি। তোলপাড় করা দুনিয়ায় আমার ভাবনার শেষ নেই।
কী ভাবছ, বলবে? আমি তোমার ভাবনার অংশী হতে চাই।
মেরিনার প্রিয় গানের কথা ভাবছি। ও আমাকে এই গানটি গাইতে বলছে।
আকমল হোসেন গান শোনার অপেক্ষা করেন। একটু আগেই তিনি বুঝে গেছেন যে, আয়শার নিজের ভেতরে ফিরে আসার প্রস্তুতি শেষ। এখন তিনি মেরিনার সঙ্গে কথা বলছেন। নিজের সঙ্গে কথাও। আকমল হোসেন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দূরে তাকালেন। ভেসে ওঠে গুনগুন ধ্বনি—
আমার যাবার বেলাতে সবাই জয়ধ্বনি কর।
ভোরের আকাশ রাঙা হলো রে,
আমার পথ হলো সুন্দর।।
আয়শা একমুহূর্ত থেমে বলেন, তুমি কি গাইবে আমার সঙ্গে?
আকমল হোসেন চমকে আয়শার দিকে তাকান। বলেন, হ্যাঁ, গাইব। মেরিনার প্রিয় গানটি আমিও গাইতে চাই, আশা।
তুমিও ওর কথা শুনতে পাও?
আকমল হোসেন চুপ করে থাকেন।
আমি শুনতে পাই। প্রতিদিন আমি ওর সঙ্গে কথা বলি।
তিনি আবার শুরু করেন গানের ধ্বনি–
কী নিয়ে বা যাব সেথা ওগো তোরা ভাবিস নে তা,
শূন্য হাতেই চলব বাহিরে
আমার ব্যাকুল অন্তর।।
মালা পরে যাব মিলনবেশে, আমার পথিকসজ্জা নয়
বাধা বিপদ আছে সঁঝের দেশে,
মনে রাখি নে সেই ভয়।
যাত্রা যখন হবে সারা
উঠবে জ্বলে সন্ধ্যাতারা, পূরবীতে করুণ বাঁশরি
দ্বারে বাজবে মধুর স্বর।
আকমল হোসেনের মনে হয়, আয়শার গুনগুন ধ্বনি আজ বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আয়শা গুনগুন ধ্বনি থামিয়ে বলেন, মেয়েটির যাত্রা তো শেষ হয়েছে। সন্ধ্যাতারা কি জ্বলে উঠেছে? তুমি কি দেখেছ? খুঁজেছ নাকি সন্ধ্যাতারা?
আকমল হোসেন দুহাতে মুখ ঢাকেন।
আয়শা খাতুন প্রাঙ্গণে দৃষ্টি ফেলে বলেন, মানুষের দ্বারে কি মধুর স্বর বাজছে? শহীদের জন্য ঘরে ঘরে প্রার্থনার মতো বলা হচ্ছে কি, তোমরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছ, আমরা তোমাদের জয়গান গাইছি। আহ্, ওরা তো নির্ভীক পায়ে যাত্রা শেষ করেছে। ওদের শেষ যাত্রায় জয়ধ্বনি করতে বলেছে।
তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?
না, না। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
আকমল হোসেন দেখলেন, আয়শা জ্ঞান হারিয়েছেন। সবাই মিলে তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যায়।
দিন সাতেক পর আবার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে শহর। দুদিন আগে এসেছিল ছেলে দুটো। স্কুলের ছাত্র, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। পাঁচ পাউন্ড পিকে নিয়ে গেছে তাঁর কাছ থেকে।
এই দুজনের লক্ষ্য ছিল ডিআইটি টাওয়ারের ওপরে টেলিভিশনের যে অ্যান্টেনা টাওয়ার আছে, সেটিকে কাটিং চার্জ করে ফেলে দেওয়া। নানা বাধায় সুযোগ করতে পারেনি। এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ডিআইটির একজন কর্মচারী মাহবুব। তিনি নাটক করেন। জন আর ফেরদৌসকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। ভেতরে ঢোকার পাস জোগাড় করে দিয়েছেন।
টেলিভিশন স্টুডিও থাকার কারণে ডিআইটি ভবনের সিকিউরিটিতে খুবই কড়াকড়ি। চেকিংয়ের শেষ নেই। প্রধান দুটো গেটের একটি খোলা থাকে ভেতরে ঢোকার জন্য। তা-ও আবার প্রতি ফ্লোরে আছে চেকিংয়ের ব্যবস্থা। মূল ভবনে ঢোকার মুখে আছে চেকপোস্ট। প্রতিটি তলার সিঁড়ির মুখে আছে চেকপোষ্ট। প্রতি তলার চেকপোস্ট পার হয়ে সাততলায় উঠতে হয়।
কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসে জন। আকমল হোসেন সেই হাসি দেখে জেগে ওঠেন। ওরা আছে বলে শক্তি ফুরোয় না। এক রাতে কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে গেল, ওরা ভয় পায়নি। ওদের জায়গা পূরণ করে রুখে দাঁড়িয়েছে। এখানেই মৃত্যুর শান্তি।
আগামীকাল আমরা রেকি করতে সাততলায় যাব। ভয় পাচ্ছি, এত চেকিং কাটাতে পারব কি না ভেবে।
সব অপারেশনেই রিস্ক থাকে, ছেলেরা। ভয় পেলে চলবে না, রিস্ক কাটাতেও হবে।
আমরা সেই সাহস নিয়েই তো এগোই, আঙ্কেল।
জানি। তোমাদের পিকে নেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে?
মাহবুব ভাই বারো পাউন্ড পিকে নিতে পেরেছেন। আমাদের মোলো পাউন্ড লাগবে।
মাহবুব দারুণ কাজ করেছে।
প্রথম দিন মাহবুব ভাই অফিসে যাওয়ার আগে আমি তার পায়ের কাছে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ বেঁধে আট আউন্স পিকে বেঁধে দিই। জুতোর ভেতরে পায়ের পাতার নিচে আরও আট আউন্স পিকে দেওয়া হয়। মাহবুব ভাই বারো দিনে বারো পাউন্ড পিকে বিল্ডিংয়ের ভেতরে নিয়ে গেছেন। সাততলার একটি ঘরের পুরোনো ফাইলপত্রের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
জন আবার মিষ্টি করে হাসে। একমুখ হাসি নিয়ে ফেরদৌসও আকমল হোসেনের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, এই হাসিই এখন সম্বল।
তোমাদের কি আরও পিকে দেব?
না, লাগবে না। যোলো পাউন্ড পিকে আমাদের হাতে আছে। রেকির কাজ শেষ হলে দু-এক দিনের মধ্যে অপারেশনের সময় ঠিক করব।