আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, আমরা আবার জয়ী হব, বাবারা।
আয়শা ওদের দুহাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলেন, তোমরা আমার প্রাণ।
ছেলেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা এই বাড়িটা গুছিয়ে দেব? যারা তছনছ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এটাও একটা প্রতিশোধ।
না। এভাবেই থাকুক কিছুদিন। এভাবে থাকলে মেরিনা নেই এ সত্য আমরা তীব্রভাবে বুঝতে পারি।
কত দিন এভাবে থাকবে?
আমি জানি না।
স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত কি?
হতে পারে। তোমাদের জন্য চা নিয়ে আসি।
আয়শা খাতুন উঠে যান। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন বলেন, তোমরা ঢাকায় কত দিন থাকবে?
আপাতত যাচ্ছি না। পরশু আমাদের অপারেশন আছে। সিরিজ অপারেশনের চিন্তা আছে।
কোন পথে ঢুকেছ তোমরা?
আমরা গোপীবাগের পেছন দিয়ে ঢাকায় ঢুকেছি। ওখানে একটা গ্রামে ক্যাম্প করা হয়েছে। আস্তে আস্তে গোলাবারুদ-অস্ত্র ঢাকায় আনা হবে। সাভারের দিক থেকেও গেরিলারা ঢাকায় ঢুকছে। দলে দলে গেরিলারা ঢাকায় ঢুকবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, পাকিস্তানি আর্মিকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা হবে। যেন ওরা দম ফেলার সময় না পায়। আকমল হোসেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিষণ্ণতার মধ্যে এ এক অলৌকিক আনন্দ। ছেলেরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি পায়। আয়শা খাতুন ওদের জন্য পুডিং আর চা নিয়ে আসেন। ছোট প্লেটে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দেন।
চটপট খেয়ে নাও।
এত খাবার?
তোমাদের জন্য মোটেই বেশি না। একটু খাবার তো খেতেই হবে। খিচুড়িটা আগে খাও। তারপর পুডিং। পরে চা।
ছেলেরা বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আসে। দ্রুত খেয়ে শেষ করে। যাবার সময় বলে, প্রতিদিন কোথাও-না-কোথাও কিছু ঘটবে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনলে ভাববেন, আমরা আপনাদের কাছে আছি। আমরা যাচ্ছি, জয় বাংলা মামণি।
দুজনে চুপ করে বসে থাকেন। তারা বুঝতে পারেন, তাঁদের জীবন থেকে সময় কমে যাচ্ছে। আয়শা খাতুনের মনে হয়, কত দিন ধরে তিনি যেন সোয়েটার বুনছেন না। উল-কাঁটা হাত দিয়ে ধরলে পুড়ে যায় হাত–প্রবল যন্ত্রণা তাকে উথালপাতাল করে। আগুনবিহীন পুড়ে যাওয়ার স্মৃতি তাঁর শরীর অবশ করে দেয়। তিনি সোফার ওপর পা উঠিয়ে বসেন। পেছনে মাথা হেলিয়ে দেন। দৃষ্টি ছড়িয়ে থাকে উল্টে-পাল্টে থাকা ঘরের ভেতর। কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পান না। এই বোধ তাকে ভীষণ ক্লান্ত করে। ভাবেন, শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ। এমন কাউকে যদি পেতেন যে, তাঁর পুরো সময়টুকু গানে গানে ভরিয়ে রাখত!
আকমল হোসেন সোফা ছেড়ে উঠতে চান। পারেন না। শরীর ভারী লাগছে। পিঠের ব্যথা চড়চড়িয়ে উঠছে। পা ফেলতেও কষ্ট। মনে হয় কত কাল ধরে যেন নিজের টেবিলে বসা হচ্ছে না। ডায়েরির পৃষ্ঠা খোলা হচ্ছে না। পত্রিকার খবর পড়া হচ্ছে না। ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে ভাটা পড়েছে। স্মৃতির পৃষ্ঠা ভরে থাকছে শুধু। তাঁর পাশে যদি কেউ থাকত, যদি লিখে রাখত প্রতিদিনের ঘটনা-বলত, দেখুন, কত কিছু লিখে রেখেছি আপনার জন্য। ভয় নেই, ইতিহাসের একটি তথ্যও হারাবে না। এই শহরের সবটুকু আপনার জন্য রক্ষিত আছে। আকমল হোসেন সোফায় মাথা হেলালেন। দেখলেন, তছনছ করা ঘরে দুজন মানুষ মুমূর্ষ অবস্থায় বসে আছেন। কারণ, এই বাড়ির একটি মেয়ে শহীদ হয়েছে। বাড়িটিকে যুদ্ধক্ষেত্র ভেবে তারা এই বসবাসকে নিজেদের ভেতরের সবটুকুর সঙ্গে আটকে রেখেছেন। তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের বাইরের মানুষ নন। সোফায় মাথা হেলালে দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। আর কত দিন পারবেন নিজেকে সামলাতে! সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবতে চাইলেন। পরে মনে হলো, না, ভাবাটি ভালো।
দুদিন পরই মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে গ্রেনেড ছোড়া হলো। ফোন পেলেন নাহিদের কাছ থেকে।
আমরা এভাবে শহরজুড়ে থাকব।
কেটে যায় লাইন। তিনি বসে পড়েন। বুকের ভেতর ধস। ব্যথায় কষ্ট লাগছে।
দুই দিন পর আবার খবর পেলেন, খান এ সবুর খানের ধানমন্ডির বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে।
আবার খবর পেলেন, প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশন অফিসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। একজন মারা গেছেন, দুজন আহত হয়েছেন, ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, বোমার আগুনে কাগজপত্র পুড়েছে। ঘরের ছাদ ধসে পড়েছে।
খবর জানতে পারেন তুহিনের কাছ থেকে। ওর হাসিতে ঝড় ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, আমরা গেরিলা পত্রিকা সাইক্লোস্টাইল করে ছেপেছি। দু-এক দিনের মধ্যে বিলি করতে হবে। আমি আর শমসের পত্রিকার কপি নিয়ে আসব।
ফোন রেখে দেয় ওরা। মেরিনা গেরিলা পত্রিকা বিতরণ করত। বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসত। এখন এই বাড়িতে তাকে কপি দেবে ওরা। কে বিতরণ করবে? চোখ ভিজে যায় আকমল হোসেনের। এত চোখ ভিজে গেলে তো অন্ধ হয়ে যাবেন, এই যুদ্ধের সময় কি কারও নিজে নিজে অন্ধ হয়ে যাওয়া সাজে? একদম না। নিজেকে ধমক দিয়ে নিজেকেই উত্তর দেন তিনি। আয়শা কাছে এসে বলেন, চা খাবে?
হ্যাঁ। কড়া করে চা দিতে বলল।
ডাইনিং টেবিলে এসো। নাকি বারান্দায় বসবে?
বারান্দায়। আকমল হোসেন জোর দিয়ে বলেন।
আয়শা খাতুন ভুরু কুঁচকে বলেন, বারান্দার ছোট টেবিলটা সেপাইরা ভেঙে ফেলেছে।
ড্রয়িংরুমের একটা টিপয় নিয়ে আসছি। তুমি যাও।
আয়শা খাতুন যেতে যেতে স্বস্তি পান। অনেক দিন পর ভালোবাসার মানুষটির স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর টের পেলেন আজ। যেন নিজের জায়গায় ফিরে এসেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে যুদ্ধ-সময়ের মানুষ ভাবতেন। বলতেন, আমার বয়স হয়নি। এখনো তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর। প্রতিদিনের যুদ্ধক্ষেত্রে হেঁটে যেতে পারি।