আলতাফ উত্তর দেয় না। নাজমুল দুই লাফে সিঁড়ি পার হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে। আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন টেলিভিশন দেখছিলেন। ওকে দেখে সুইস অফ করেন।
এসো, বাবা।
আমি বসব না। স্কুটার দাঁড় করিয়ে রেখেছি। মারুফ ভাই পাঠিয়েছে আমাকে।
মারুফ? মারুফ কোথায়?
ঢাকায় নেই। মেলাঘরে। আমাকে বলেছে মেরিনা আপাকে নিয়ে মেলাঘরে যেতে।
তুমি বসবে? বসো না একটু।
ফ্যাসফ্যাস করে আয়শা খাতুনের কণ্ঠস্বর। কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
জয় বাংলা মামণি, আমার বসার সময় নেই। সবাই অপেক্ষা করছে। মেরিনা আপাই কেবল বাকি। আমরা গেলেই…
দুজনকে মুখ ঢাকতে দেখে চারদিকে তাকায় নাজমুল। ঘরের লন্ডভন্ড অবস্থা দেখে কিছু আঁচ করে। বাইরে এসে আলতাফের ঘাড়ে হাত রেখে ঝাকুনি দেয়।
কী হয়েছে? খুব তাড়াতাড়ি বলেন। আমার সময় নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।
আলতাফ দ্রুত কণ্ঠে সব কথা বলে দেয়। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নাজমুলের চোখ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে বলে, শাবাশ! মেরিনা আপা এত বড় যুদ্ধ করেছে। শাবাশ। খবরটা সবাইকে পৌঁছাতে হবে। গেলাম।
স্কুটার ছাড়ার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকে আলতাফ। তারপর গেট বন্ধ করে। গেটে পিঠ ঠেকিয়ে দম নেয়। আগামীকাল এ বাড়িতে মিলাদ। ফকির খাওয়ানো হবে।
তিন দিন পর সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে মারুফ।
ছেলেকে দেখে দুজনই চমকে ওঠেন।
মারুফ, তুই? আয়শা খাতুন আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন। মারুফ মাকে ব্যাকুল শোকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকমল হোসেন ছেলের ঘাড়ে মুখ রেখে নিজের চোখের জল সামলান। মারুফ বাবার ঘাড়ে মাথা ঘষে, আবার মায়ের বুকে আশ্রয় নেয়।
এই মুহূর্তে এই বাড়িতে সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে। এক-একটি মুহূর্ত অনন্তকাল হয়ে যায়।
বাবা-মা দুজনে ছেলেকে নিয়ে মেরিনার ঘরে আসেন। মারুফ বলেছে, এই বাড়িটা এখন একটা বিপজ্জনক জায়গা জেনেও আমি এসেছি, আব্বা-আম্মা। ওর ঘরে একটি মোমবাতি জ্বালাতে এসেছি।
তুই মেলাঘর থেকে কবে এলি?
আজই দুপুরে এসে পৌঁছেছি।
কবে যাবি? কা
লকে যাব। নাজমুলের কাছ থেকে খবরটা শোনার পরে অনেকে আমাকে এই বাড়িতে আসতে না করেছে। আমি অনেকক্ষণ এই বাড়িকে নজরে রেখে তার পরে ঢুকেছি। সতর্কতার সঙ্গে এসেছি, আব্বা।
মেরিনার ঘরে আলো জ্বলছিল। সারা রাত এই ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখেন আয়শা খাতুন। রান্নাঘর থেকে একটি মোম জ্বালিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। মারুফের হাতে দেন। মারুফ খাটের ওপর মেরিনার মাথার কাছে কতগুলো বই রেখে তার ওপর মোম রাখে। নিচে বসে কাঠের ওপর মাথা ঠেকিয়ে রাখে ও।
আয়শা খাতুন নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘরের ভেতরে গুনগুন ধ্বনি ছড়ায়—আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে। তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে…।
আকমল হোসেন নিচু হয়ে ছেলেকে টেনে তোলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আয়শা খাতুন আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মোছেন, ছেলের চোখ মোছেন। পুরো পরিবার একটি মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবেন, তাদের মেয়েটি মরে যায়নি। ও এখন একটি প্রজ্বলিত আগুনের শিখা।
সময় ফুরোয়।
মারুফ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি এখন যাই।
আয়শা খাতুন ওর হাত ধরে বলেন, আমাদের সঙ্গে খেয়ে যা। তোকে বেশিক্ষণ আটকাব না।
ডাইনিং টেবিলে আবার নিস্তব্ধতা।
ঠিকমতো খেতে পারে না কেউ। খাবার মুখে ওঠানো কত যে কঠিন কাজ, এ কাকে বলে বোঝাবে কে। তবু মারুফ প্লেটের ভাত শেষ করে। ডাল উঁাড়শ ভাজি আর ডিমের তরকারি দিয়ে। মায়ের রান্নার আগের টেস্টও নেই। ডাইনিং টেবিলের আয়োজনও নেই।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার পেট ভরে গেছে, আম্মা। আপনাদের খাওয়া শেষ হলে আমি হাত ধোব।
আমাদের খাওয়া!
শেষ করবেন না?
করব তো। অনেক সময় লাগবে।
আমার তো বেশি রাত করা উচিত না। পথেঘাটে কত বিপদ।
ও, তাইতো।
দুজনে দ্রুত খেয়ে শেষ করেন। ডাল আর ভাজি ঠিকমতো খাওয়া হয় না। ডিমের তরকারি তো প্লেটেই ওঠে না।
মন্টুর মা টেবিলের কাছে এসে বলে, এরকম করে খেলে তাদের শরীর কি ঠিক থাকবে!
আব্বা-আম্মাকে আপনারা দেখবেন, বুয়া।
আমরা তো চেষ্টা করি। সব সময় পেরে উঠি না।
দুজনে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধোন। মারুফও উঠে এসে বাবা-মায়ের কাছে দাঁড়ায়।
তুই এখন কোথায় যাবি, বাবা?
ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে। সকালে উঠে মেলাঘরে চলে যাব।
কয় দিন থাকবি মেলাঘরে?
বেশি দিন না। কমান্ডার আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। নতুন তেজে গেরিলাদের আবার ঢুকতে হবে ঢাকায়। গোলাবারুদ-অস্ত্র নিয়ে। আগস্ট মাসে গেরিলাদের ধরা পড়ার পরে ঢাকা শহরে গেরিলা তৎপরতা যে কমেছে, এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। আমরা আরও দ্বিগুণ প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় ঢুকব।
মারুফ তোয়ালেতে হাত-মুখ মুছে বলে, যাই, আম্মা।
যাবি?
যেতে তো হবেই, আম্মা।
আয়শা খাতুন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
এখন কান্নার সময় নয়, আশা। এখন বুকে পাথর বাধার সময়। আমরা তো এই প্রতিজ্ঞা নিয়েছি।
যাই, আব্বা।
কবে আসবি?
সাত দিনের মধ্যে ঢাকায় ঢুকব।
বাড়িতে আসবি তো?
এবার আমার হাইড হবে ফার্মগেটের বাড়িতে। ওখানে থেকেই অপারেশনে যাব। দোয়া করবেন আমার জন্য। কবে বাড়িতে আসতে পারব, তা বলতে পারছি না।
মারুফ দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
আলতাফকে বলে, সাবধানে থাকবেন। আসি।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছন দিকে তাকায় না। দ্রুত রিকশায় ওঠে।
সাত দিনের মাথায় বৃষ্টি মাথায় করে দুজন যোদ্ধা আসে আকমল হোসেনের বাড়িতে। আয়শা খাতুন ওদের তোয়ালে দেন ভেজা শরীর মোছর জন্য। ওরা শিহাব আর কামরুল। বয়স কম। মাত্র স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আমরা আবার ঢাকা শহরে ঢুকেছি। আগামীকাল থেকে এই শহর চাঙা করে তুলব।