আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে৷।
তবু প্রাণ নিত্যধারা,
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা, বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,
নাহি নাহি দৈন্যলেশ—সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে৷৷
শেষের লাইনটি আকমল হোসেন নিজেও গুনগুন স্বরে গাইতে থাকেন। আবার প্রথম লাইন গান দুজনে—আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
আকমল হোসেন নিজেকে সামলাতে পারেন না। আয়শা খাতুন তাকে শান্ত করার জন্য দ্বিতীয় পঙক্তিতে যান—তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগো কিন্তু দ্বিতীয় পঙক্তি গাওয়ার পর আয়শা খাতুন নিজেও কাঁদতে শুরু করেন।
এই প্রথম তার গুনগুন ধ্বনি কান্নার শব্দে মিশে যায়। দুজনের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়—
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ
নাহি নাহি দৈন্যলেশ…।
স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্ষয় নেই, শেষ নেই। স্বাধীনতার অনন্ত বাণী ছড়াতে থাকে আকাশে। দুজন মানুষ দেয়ালে পিঠ ঠেকান, মাথা ঠেকান। রাত শেষ হয়। দিনের প্রথম আলো ছড়ায় চারদিকে।
ঘরের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে আলতাফ। পেইন কিলার খাওয়ার পরও শরীরের ব্যথা কমেনি। তার পরও উঠে কোথাও যেতে পারে না। গত রাতে বাড়িটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়েছে। নতুন এই যুদ্ধক্ষেত্র তার জন্য চ্যালেঞ্জ।
রান্নাঘরে বসে থাকে মন্টুর মা। পুরো রান্নাঘর তছনছ হয়ে আছে। কেরোসিনের চুলা ভেঙে দিয়েছে। রান্না করতে হলে নতুন চুলা আনতে হবে। কাচের প্লেট-গ্লাস টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। গত রাতে এই বাড়িতে যুদ্ধ হয়েছে।
একটি মেয়ে শহীদ হয়েছে।
ও মা গো, ও আল্লাহরে—
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মন্টুর মা। মাঝেমধ্যে সুর করে বিলাপ করে। কপাল আছড়ায়। ওর বিলাপের নানা কথা ছড়াতে থাকে বাড়িতে। আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন সোজা হয়ে বসেন। বিলাপের নানা কথা তাঁদের কাছে পৌঁছে যায়। দুজন আবার স্তব্ধ হয়ে পড়েন। স্মৃতিভরা এমন অজস্র কথা তো তাঁদেরও আছে। আমৃত্যু তারা এই সব কথা স্মরণ করবেন। এখন যুদ্ধ।
দুজনে উঠে মন্টুর মায়ের কাছে আসেন। আয়শা খাতুন তার পাশে বসে বলেন, থামো, মন্টুর মা। আমাদের এখন অনেক কাজ আছে।
বাড়ি তো যুদ্ধের ময়দান হয়েছে।
হবেই। আমাদের চারদিকে যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের ময়লা এখন আবার সরাব।
অ, তাই তো। রান্নাঘরের ময়লা আমি একাই সরাতে পারব। এইটা কি আমার যুদ্ধ?
হ্যাঁ, তোমার যুদ্ধ।
ততক্ষণে আলতাফও বাড়ি পরিষ্কার করার কাজে লেগেছে। মাঝেমধ্যে বসে দম নিচ্ছে। চারদিকে তাকাচ্ছে। মাথা চাপড়াচ্ছে। আকমল হোসেন কাছে এলে আলতাফ বলে, আপনি কোথাও যাবেন, স্যার?
কোথায়? সেই রাস্তার ধারে। যেখানে জিপটা উল্টে গেছে।
না, শুধু উল্টে যায়নি। পুড়েছে। টুকরো টুকরো হয়েছে।
আলতাফ গভীর আগ্রহ নিয়ে বলে, সেখানে যাবেন, স্যার?
হ্যাঁ, যাব। শুধু তুমি আর আমি।
আকমল হোসেন পেছন ফিরে দেখলেন আয়শা রান্নাঘরে। তিনি আলতাফকে ইশারা করলেন। দুজনে গেট খুলে দ্রুত বের হলেন।
মাথার ওপর সূর্য। চারদিকে ঝকমকে রোদ।
তাঁরা ঘটনার জায়গায় পৌঁছাতে পারলেন না। অনেক দূর জুড়ে রাস্তা ঘিরে রেখেছে মিলিটারি পুলিশ।
দুজনে শিরীষগাছের নিচে দাঁড়ালেন। আকমল হোসেন পরক্ষণে আলতাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো, ফিরে যাই। আমাদের যুদ্ধ তো শেষ হয়নি।
দুজনে দ্রুত পায়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আলতাফ বলে, স্যার, আপনি তো বললেন আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি।
বলেছি। ঠিকই তো বলেছি।
ওরা এই বাড়িতে আবার আসতে পারে। তাহলে আপনি এই বাড়ি থেকে চলে যান।
না। এটা দুর্গবাড়ি। এখানে এখনো অস্ত্র আছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আসবে।
ওরা যদি এসে আপনাদেরকে ধরে নিয়ে যায়? তখন কী করবেন? আমরা চাই না এমন কিছু ঘটুক। আপনারা চলে যান। বাড়ি আমি একা পাহারা দেব।
না, তা হবে না। ধরে নিয়ে গেলেও আমি বাড়ি ছাড়ব না। এই বাড়ি থেকে আমার মেয়ে বেরিয়ে গেছে। এই বাড়িতে এখনো আমার ছেলে ফেরেনি। আমি বাড়িতে থেকেই শেষ দেখতে চাই রে, আলতাফ।
দুজনে গেটের ভেতরে ঢুকলে দেখতে পায় আয়শা খাতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়িতে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় গিয়েছিলে?
সেই জায়গায়। মেয়েটার হাড়গোড় খুঁজতে গিয়েছিলাম।
বুঝেছি। চলো, ঘরে চলো। আমাকে না বলে চলে গেলে কেন?
আকমল হোসেনের হাত ধরে আয়শা বলেন, তোমার গায়ে জ্বর দেখছি।
কখন জ্বর এল, টের পাইনি তো।
পেয়েছ ঠিকই। আমায় লুকাচ্ছ। ডাইনিং টেবিলে এসো। তোমাকে একটা নোভালজিন দিচ্ছি।
না, নোভালজিন লাগবে না। আমি ঘরে যাচ্ছি। আমি ঠিক আছি, আশা।
আকমল হোসেন দ্রুত পায়ে শোবার ঘরে যান। আয়শা পিছু পিছু যেতে পারেন না। তাঁর মনে হয়, মানুষটা নিজেকে সারানোর সময় চাচ্ছে। তাকে ডিসটার্ব না করাই উচিত।
আয়শা খাতুন চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকেন। জানেন, যেকোনো সময় আর্মির গাড়ি এ বাড়িতে আবার আসবে। আসুক, তিনি নিজেকে বলেন—আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ।
১৪. দুদিন পর এক সন্ধ্যায়
দুদিন পর এক সন্ধ্যায় স্কুটার নিয়ে এ বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ায় নাজমুল। ওকে দেখে গেট খুলে দেয় আলতাফ। ও উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, আঙ্কেল কই?
ড্রয়িংরুমে।
জয় বাংলা মামণি কেমন আছে? কথা বলছ না যে? তোমারই বা কী হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?