মেরিনা দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
এতক্ষণ ধরে বাড়িঘর তছনছ করেছে সেপাইরা। জিনিসপত্র চারদিকে ছুড়ে মেরেছে। তোশক-বালিশ-সোফার কভার, কুশন ছিন্নভিন্ন করে বাড়িতে তুলো উড়িয়েছে। আসবাবপত্র উল্টে ফেলেছে। সবই দেখে মেরিনা। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট। নিজের অজান্তেই নিজের হাত টাইম বোমার ওপর চলে যায়। মারুফ ওকে যুদ্ধের শুরুতেই গ্রেনেডের পিন খোলা শিখিয়েছে। আজ ওর সেই চরম পরীক্ষা। তবে গ্রেনেড নয়, টাইম বোমা।
ও ড্রয়িংরুমে আসতেই ক্যাপ্টেন দন্ত বিকশিত করে বলে, আইয়ে। বহুত যুব সুরত।
সেপাইগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। পা দাপায় না বা রাইফেল তাক করে না। ক্যাপ্টেন মেরিনার পাশাপাশি হাঁটে, যেন এই মুহূর্তে মেরিনা সম্রাজ্ঞী। ওরা তার আজ্ঞাবহ দাস। এমন এক ভঙ্গি ওদের আচরণে। কারণ, সে ধরে নিয়েছে যে আর অল্পক্ষণ পরই এই সম্রাজ্ঞী তার হাতের মুঠোয় আসবে। কিছুক্ষণ সময়ের ব্যবধান মাত্র। তার উত্তেজনা অনেক কষ্টে দমন করে রাখে।
ঘর পেরিয়ে বারান্দায় এলে মেরিনা দেখতে পায় আকমল হোসেনকে। বারান্দার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে রক্ত। মারের চোটে নাক-ঠোঁট-ঘাড়সহ বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ও ছুটে বাবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ক্যাপ্টেন হাত দিয়ে বলে, নো। ইধার নেহি, উধার।
ক্যাপ্টেন সিঁড়ি দেখিয়ে দেয়।
মেরিনা যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই আর্তচিৎকার করে, আব্বা। আকমল হোসেন সাড়া দেন না।
আপ চলিয়ে।
আব্বা, আব্বা। বাবার সাড়া নেই। বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছেন।
আবার পা বাড়াতে গেলে ক্যাপ্টেন বাধা দেয়।
নেহি। ইধার।
ক্যাপ্টেন মেরিনার হাত ধরে টেনে আনে। ওকে আর কোনো সুযোগ দেয় না। একজন পিঠের ওপর রাইফেলের নল লাগিয়ে রাখে। পেছন ফিরে তাকানোরও সুযোগ নেই। ওর মনে হয়, এখন সোজা হেঁটে গাড়িতে ওঠাঁই উচিত। টানাহেঁচড়া করলে বোমাটা পড়ে যেতে পারে। ও মুহূর্তে সতর্ক হয়।
গাড়ি সরে যায় গেটের সামনে থেকে। আড়ালে লুকিয়ে থাকা মন্টুর মা ছুটে এসে গেট আটকায়। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন আয়শা খাতুন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন জিনিসের পাশ কাটিয়ে আকমল হোসেনের কাছে আসেন। মাথা তুলে ধরতেই বুঝতে পারেন জ্ঞান হারিয়েছেন।
চিৎকার করে ডাকেন, আলতাফ, মন্টুর মা।
আলতাফ ততক্ষণে নিজে নিজে উঠেছে। মার খেয়ে জ্ঞান হারায়নি ও। ঘাপটি মেরে পড়ে ছিল। তার পরও যাবার সময় একজন পিঠে লাথি দিয়েছিল।
বলেছিল, শালা গাদ্দার।
আয়শা খাতুনের চিৎকার শুনে আলতাফ বারান্দায় উঠে আসে। আকমল হোসেনকে পড়ে থাকতে দেখে নিজের শরীরের অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভুলে যায়। মন্টুর মা গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসে।
আয়শা খাতুন পানি দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেন। ঠোঁটে পানি দিলে সে পানি গড়িয়ে পড়ে যায়। তিনি বলেন, ঘরে নিয়ে চলো।
তাঁকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করার সময় তিনি নড়ে ওঠেন। চোখ খোলেন। বলেন, পানি খাব।
পানি খেয়ে তিনি চারদিকে তাকান। তারপর উঠে বসার চেষ্টা করেন। সবাই মিলে তাকে সাহায্য করে। তিনি উঠে বসেন। বলেন, ওরা আমার ঘাড়ে মেরেছিল। আরও অনেক জায়গায়। আমার কিছু মনে নেই।
চলো, তোমাকে ঘরে নিয়ে যাই।
তোমাকে ওরা মারেনি তো, আশা?
না, আমাকে মারেনি।
আমার মা কোথায়? আমার মেরিনা?
যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে গেছে।
ফ্রন্টে? ও বাড়িতে নেই তাহলে?
জানো, ও খুব সাহসী ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আব্বা, আব্বা করে খুব ডেকেছিল।
ডাকবেই তো। ও তো আমারই অংশ।
তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে।
সবাই চমকে পরস্পরের দিকে তাকায়। রাস্তায় মানুষের হইচই শোনা যায়। আকমল হোসেনের মনে হয়, তার গায়ে পুরো শক্তি ফিরে এসেছে। তিনি আয়শা খাতুনের দিকে তাকান।
মেয়েটাকে টাইম বোমা দিয়েছিলে?
দিয়েছিলাম।
তাহলে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে ও জয়ী হয়েছে।
মুহূর্ত সময় মাত্র। তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে পুরো পরিবার।
রাতের মধ্যপ্রহর শেষ হয়েছে।
শেষ রাতে আকমল হোসেন বিছানায় উঠে বসেন। দেখতে পান, ঘরে আয়শা খাতুন নেই। বিছানা থেকে নামলেন। দেখলেন, বাথরুমে নেই। বিছানায় শোয়ানোর সময় আয়শা তাকে পেইন কিলার দিয়েছিলেন। শরীরের ব্যথা খানিকটা কমেছে। মাথা টলছে। তার পরও পা বাড়ালেন। আয়শা কোথায় দেখতে হবে। মেরিনার ঘরে কি? ঠিকই ধরেছেন। একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন আয়শা। পুরো ঘর তছনছ করা। কাপড়চোপড়-বইপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তিনি পাশ কাটিয়ে আয়শা খাতুনের পাশে গিয়ে বসলেন।
উঠলে কেন? শরীর ঠিক আছে?
তোমার কাছে এসেছি, আশা।
বসো। এসো। আমার হাত ধরো।
আকমল হোসেন স্ত্রীর পাশে বসেন। বুঝতে পারেন, বুক ভেঙে যাচ্ছে। বুঝতে পারেন, মাথা সোজা করে রাখা কঠিন হচ্ছে। চোখের জল সামলানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আয়শা মৃদু স্বরে বলেন, শহীদের জন্য আমরা শোক করব না।
ওর জন্য গৌরব বোধ করব।
আকমল হোসেন দুহাতে বুক চাপড়ান।
আয়শা হাত টেনে ধরেন।
এখন মাতমের সময় নয়।
আমি জানি, শোককে শক্তি করার সময়। সামনে আমাদের অনেক কাজ।
ওর জন্য আমরা কুলখানি করব। মিলাদ হবে। ফকির খাওয়াব। কোরআন খতম হবে।
হ্যাঁ, সবই হবে।
শহীদের স্মরণে তোমার একটি গুনগুন ধ্বনি হবে না, আশা?
আমি এতক্ষণ সেই শক্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাকে পেয়ে আমার মধ্যে শক্তি ফিরে এসেছে।
আকমল হোসেন দুহাতে আয়শাকে বুকে টানেন। তাঁর মাথার ওপর নিজের থুতনি রেখে বলেন, আয়শা, তুমি আমার মধ্যে শক্তি ভরে দাও। আমি যেন শহীদ মেয়েটির স্মৃতি বুকে নিয়ে কিছুকাল বেঁচে থাকি। আয়শা খাতুন সুর করেন–