কোথায় রেখেছ?
এই যে, দেখো।
ও কোমরে গুঁজে রাখা ছুরি দুটো দেখায়। চমকে ওঠেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।
এখনই কোমরে গুঁজেছ কেন? বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে খুঁজলেই হতো।
প্র্যাকটিস করছি। হঠাৎ করে খুঁজলে অসুবিধা ফিল করতে পারি। কোমরে খুঁজে হাঁটছি, বসছি এবং শুয়েও দেখেছি। তেমন অসুবিধা দেখছি না। তবে বেকায়দা হলে আমার পেটেও ঢুকে যেতে পারে।
খিলখিল করে হাসে মেরিনা। ওকে হাসতে দেখে আবার চমকে ওঠেন দুজনে। হাসতে হাসতে মেরিনা বারান্দায় যায়। সেখান থেকে সামনে নামে। গাছ থেকে একটি জবা ফুল ছিঁড়ে চুলের ক্লিপে গেঁথে রাখে। দু-এক লাইন গান গাইবার চেষ্টা করে। মন ভালো থাকলে ও গান গায়। আয়শা খাতুনের আফসোস যে, মেয়েটা ঠিকমতো গান শিখল না। শিখলে ভালো গাইতে পারত। ওর গানের গলা দারুণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দু-একবার গেয়েছিল। দর্শকের প্রশংসা পেয়েছিল। তার পরও ঠিকমতো শেখা হলো না ওর। আজ ও নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে গাইল
হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে।
বেদন বাশি উঠল বেজে বাতাসে বাতাসে।।
কিছুক্ষণ গাইলে আলতাফের কান্না বন্ধ হয়ে যায়। ও ঘরের বাইরে এসে চৌকাঠের ওপর বসে থাকে। একমনে গানটি শোনে। ও জানে, মেরিনা সব সময় গান গায় না। আজ তার মেজাজ খারাপ। তার পরও গাইছে।
ঘরে আয়শা খাতুন সোয়েটার বুনছিলেন। হাত থেমে যায়। উল আর কাঁটা এক হয় না। আকমল হোসেন নিজের টেবিলে বসে পত্রিকার পাতা উল্টান। বিভিন্ন নিউজে চোখ আটকে যায়। তার পরও নিউজের ভেতরে ঢুকতে পারেন না। হেড লাইন পড়ে ছেড়ে দেন।
সবশেষে চোখ পড়ে একটি খবরে—কোম্পানীগঞ্জের বামনিবাজারে আর্মি ও রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। চৌদ্দ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে আর্মি ও রাজাকাররা।
তিনি কাগজ রেখে বাইরে আসেন। দেখলেন, মেরিনা নেই। ও ঘরে চলে গেছে। ওর ঘরের দরজার সামনে ছোট ব্যাগটি রাখা আছে। তিনি ভাবলেন, কাল সূর্য ওঠার আগেই তিনি মেরিনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। ওর নানার বাড়িতে রেখে আসবেন। ওখান থেকে কারও সঙ্গে মেলাঘরে চলে যাবে।
রাত দশটার দিকে তিনটি মিলিটারির গাড়ি আসে বাড়ির সামনে। দূর থেকে আর্মির গাড়ি গেটের সামনে থামতে দেখে আলতাফ হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢোকে।
ভয়ে-আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলে, স্যার, গাড়ি। গাড়ি।
কার গাড়ি?
আর্মির।
ততক্ষণে বুটের পদাঘাতে থরথর করে কাঁপে লোহার গেট।
আকমল হোসেন আলতাফের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, যাও, গেট খুলে দাও।
আলতাফ চলে যায়। ওকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মায়ের ঘরে ঢোকে মেরিনা।
তাহলে ওরা এসে গেছে? নওশীনও এসেছে কি?
আলতাফ গেটের তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজন। কিল-ঘুষি-লাথি দিয়ে ফেলে দেয় ওকে। ও পড়ে থাকে গেটের পাশে।
আকমল হোসেন বারান্দার দিকে এগিয়ে যান। ক্যাপ্টেনসহ সেপাইরা ততক্ষণে বারান্দায় এসে উঠেছে। পেছনে নওশীন। ওরা আকমল হোসেনকে প্রথমে রাইফেলের বাট দিয়ে পিঠে আঘাত করে। তারপর জিজ্ঞেস করে, মুকুত কিধার? আর্মস-অ্যামুনিশন কিধার?
আকমল হোসেন চুপ করে থাকেন।
ওরা একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে আবার বলে, বাত কিউ নেহি বোলতা?
আবার রাইফেলের বাটের বাড়ি পড়ে। আকমল হোসেন মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। উঠতে পারেন না।
একজন ক্যাপ্টেন সেপাইদের দিকে তাকিয়ে বলে, গো, সার্চ।
দুপদাপ করে এগিয়ে যায় ওরা।
ততক্ষণে মেরিনাকে রেডি করে ফেলেছেন আয়শা খাতুন। আলমারির ভেতর থেকে একটি টাইম বোমা বের করে মেরিনার ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। একই সঙ্গে টাইম ফিক্স করে দেন।
ওরা যতজন এসেছে, শুধু ছুরি দিয়ে হবে না। বড় অস্ত্র লাগবে।
বুঝেছি। মেরিনা শক্তই থাকে। নওশীনের ফোন পাওয়ার পর থেকে অনেক বোঝাপড়া হয়েছে নিজের সঙ্গে। এখন ও আর ভীত নয়। শক্তভাবেই মনে করে, ওরা শরীরে হাত দেওয়ার আগেই সুইসাইড স্কোয়াড হওয়া জরুরি। গাড়িতে যতগুলো থাকবে তার সবগুলো মরবে। হাহ, প্রিয় স্বাধীনতার জন্য নিজেকে তৈরি করে, মেয়ে। ও বুকের ওপর সুতির শাড়ি ভাঁজ করে বোমাটা খানিকটা আড়াল করার চেষ্টা করে। আয়শা খাতুন নিজের পছন্দের একটা কাশ্মীরি শাল মেয়ের গায়ে জড়িয়ে দেন।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলেন, পারবি না, মা?
পারব। আমি পারবই। আমার জন্য ভাববেন না।
আমি জানি, তুই পারবি।
বোমার ওপর হাত রাখেন আয়শা খাতুন। বিদায়, আম্মা।
বিদায়! বিদায়! বিদায়!
আয়শা খাতুন চমকে মেয়ের দিকে তাকান।
বিদায়ই তো, আম্মা। আর দেখা হবে না। কোনো দিনই না।
ঘরে এসে দাঁড়ায় সেপাইরা। পেছনে নওশীন। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ে একসঙ্গে বলেন, স্টপ। থাম।
পেছন থেকে নওশীন এগিয়ে এসে বলে, খুব সাহস দেখাচ্ছ। ছ্যাঁচা খেয়ে ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি বেশি কথা বলবে না, নওশীন। তুমি একটা বেইমান। বিশ্বাসঘাতক।
তবে রে। বড় বড় বুলি আওড়াতে শিখেছ। স্বাধীনতার পাছায় লাথি মারি।
নওশীন সেপাইদের ইঙ্গিত করলে ওরা এগিয়ে আসার আগেই আয়শা খাতুন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলেন, ভদ্র ব্যবহার কর, নওশীন। কী করতে হবে, বল।
ওকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।
ঠিক আছে, যাবে। যাও, মা।
সেপাইদের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ডোন্ট টাচ হার।