আকমল হোসেনের মনে হয়, মেয়ের জেদের সঙ্গে তিনি পারবেন না। দুদিন পর চেনা আস্তানা খোঁজ করেন। কোথাও কেউ নাই। যারা পেরেছে নদী পার হয়ে চলে গেছে। যারা ঢাকায় আছে, তারা সবাই আস্তানা বদল করেছে। কেউ কারও খবর বলতে পারছে না। আশরাফ বলে, একসঙ্গে কয়েকজন গেরিলা ধরা পড়ল, এত বড় একটা বিপর্যয়ের পর শহর নীরব হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ নীরবতা কয়েক দিনের জন্য মাত্র। আবার ফুটবে বোমা, পুড়বে পেট্রল পাম্প-পাওয়ার স্টেশন, গুলিবিদ্ধ হবে শত্রুসেনারা কিংবা তাদের দোসররা।
আকমল হোসেনও তা-ই মনে করেন।
খবরের কাগজ খুলে বসলে দেখতে পান, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস পালনের তোড়জোড় চলছে।
শির দেগা, নাহি দেগা আমামা—এই স্লোগান দিয়ে দিবস উদযাপন করা হবে। প্রতিরক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে শুরু হবে সভা-সমাবেশ। মিছিল। আকমল হোসেন কাগজ ভাঁজ করে রেখে উঠে পড়েন। ফার্মগেটের বাড়ির ভাড়া দিতে হবে। ছেলেদের খোঁজ নিতে যাবেন। ড্রয়িংরুমে আসতেই ফোন বাজে।
অপর প্রান্তে নওশীন।
হ্যালো, আমাকে মেরিনাকে দেবেন।
তুমি কে, বাবা?
আমি নওশীন। মেরিনাকে দিন।
মেরিনাকে কেন চাইছ? ওর সঙ্গে কী দরকার?
ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে। আমি ওকে চাই। আপনি ফোন দেন।
ও বাড়িতে নেই। ও ওর খালার বাসায় আছে।
মিথ্যা কথা বলবেন না। আমি জানি, ও বাড়িতে আছে। আজ বের হয়নি। আমাদের লোক আপনার বাড়ির ওপর নজরদারি রাখে।
ওহ্, মাই গড।
ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনি না সাহসী বীরযোদ্ধা। দেশকে স্বাধীন করবেন বলে জানপ্রাণ দিয়ে খাটছেন। আপনার পরিবারকে ধরে…
আকমল হোসেন ফোন রেখে দেন। আয়শা এসে ওটা ক্রেডলে না রেখে পাশে রাখেন। মেরিনাও বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আকমল হোসেন বলেন, তোমাকে অন্য জায়গায় যেতেই হবে, মা। বুঝতে পারছি, ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর্মির কাছে নিজের বাহাদুরি দেখাবে।
আয়শা বলেন, যাও মা, ছোট একটা ব্যাগ রেডি করে নাও।
মেরিনা কথা না বলে বের হয়ে যায়। থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার পাশে। একসঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধা দেখার পর এমন একজন রাজাকার দেখতে হবে—এটা ও ভাবতেই পারে না। ক্রোধ ওকে উত্তেজিত করে। যে ছুরিটা কিনেছে, সেটা ওর বুকে বেঁধানো উচিত। হোক ও বান্ধবীর ভাই, তাতে কিছু যায়-আসে না।
সেদিন বিকেলে কেঁদেকেটে বাড়ি তোলপাড় করে আলতাফ। ওর সঙ্গে কাঁদে মন্টুর মা। খবরটা প্রথমে মন্টুর মা-ই দেয় সবাইকে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে, আলতাফের বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে।
কী খবর এসেছে? ওর বাবা ভালো আছে তো? বাড়ির অন্যসব খবর ভালো?
অত কিছু জানি না। শুনেছি ওর ভাই মারা গেছে।
ওর তো পাঁচ ভাই। কোন ভাই মারা গেল? যে
ভাইটা রাজাকার হয়েছিল।
মন্টুর মা চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।
আয়শা বলে, বোধ হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে মারা গেছে। পাকিস্তানি আর্মি তো আর ওকে মারবে না।
হতে পারে। ঠিকই বলেছ। অথবা কোনো অসুখেও মারা যেতে পারে।
জওয়ান ছেলের আবার অসুখ কী!
আয়শা বিরক্তির সঙ্গেই বলেন। আকমল হোসেন নিজের মনে হাসেন। ভাবেন, সময়টাই এমন। এখন কোনো লোক অসুখে মরবে না। সবাই মরবে গুলিবিদ্ধ হয়ে কিংবা বিস্ফোরণে। হয় শত্রুপক্ষের, নয়তো মুক্তিবাহিনীর হাতে। মৃত্যুর উত্তর বড় সহজ হয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় পুরো খবরটা আলতাফ জানাল।
মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেছিল। আমার ভাই পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে ছিল। মুক্তিসেনার গুলি খেয়েছে। ছয়জন পাকিস্তানি সেনা মরেছে। মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে দুজন।
তোমার বাবার খবর কী?
বাবা ভালোই আছেন।
আলতাফ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একদিন দেশ স্বাধীন হবে। গাঁয়ের লোকে ওর নামে ধিক্কার দেবে। কেউ বলবে না যে, ও শহীদ হয়েছে। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার ভাগ্য ওর ছিল না।
একসময় হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে, এই মরণ ওকে মরতে বলেছে কে? ওহ, আল্লারে, এর চেয়ে ও যদি নদীতে ড়ুবে মরত, তাও সান্ত্বনা পেতাম। আল্লায় আমারে এমন কষ্ট দিল ক্যান? ও আল্লারে।
মেরিনা এসে সামনে দাঁড়ায়।
থামেন তো। ও কি একটা মানুষ, তার জন্য আবার কান্নাকাটি!
আলতাফ চোখ মুছতে মুছতে বলে, ছোটবেলায় একসঙ্গে বড় হয়েছি না। ও আমার পাঁচ বছরের ছোট ছিল। কত কোলে নিয়েছি। এক থালায় ভাত ভাগ করে খেয়েছি। নিজের কথা নিজে ভুলব কেমন করে?
থামেন, বললাম। থামেন। এমন ছোটবেলা সব্বার আছে। এই ছোটবেলা নিয়ে কথা বলার কিছু নাই।
আলতাফ হা করে তাকায়। তারপর উঠে চলে যায়। বুঝতে পারে, মেরিনার মেজাজ খারাপ। মেরিনা ওর সঙ্গে এমন করে কথা বলে না। আজ তার অন্য কিছু হয়েছে।
ওর সঙ্গে মেজাজ করছিস কেন, মা? বাস্তব অবস্থা মানতে হবে।
আমার মেজাজ খারাপ, কারণ আমাকে ছোট একটা ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। আমাকে বেশি প্রশ্ন করবেন না আপনারা।
আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন ওকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে পারেন না।
ও নিজেই আবার গলা উঁচিয়ে বলে, একজন রাজাকারের হুমকি-ধমকিতে আমার ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। আমি এই দুর্গবাড়ি ছেড়ে সাধারণ বাড়িতে যেতে চাই না। তাহলে আমি যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে থাকব।
মা, কিছুদিন থাক। তারপর আবার আসবে।
না, আমি এক দিনও অন্য কোথাও থাকতে চাই না। ঠিক আছে, আমি আপনাদের কথামতো ব্যাগ গুছিয়েছি। তবে ছুরি দুটো ব্যাগে দিইনি।