আমরাও খাইনি। চা-ও না।
তাহলে তো পেটপুরে খেতে হবে এখন। আরেকটি নতুন ফ্রন্টে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হতে হবে না।
মেরিনা, ফিক করে হেসে বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। দুজনেই চমকে ওঠেন। ওর বিষণ্ণ মুখের হাসি দেখে দুজনেই ভাবলেন, যেন মর্গের ভেতরে শায়িত কেউ। দুজনের ভাত খাওয়া মাথায় উঠল।
তাঁরা ভাত নাড়াচাড়া করলেন। মাছের টুকরো বোন-প্লেটে উঠিয়ে রাখলেন।
মেরিনা তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, এভাবে খেলে আজ রাতে আমার না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে না।
আকমল হোসেন প্লেটের ওপর মাথা নামিয়ে গবগবিয়ে কয়েক গ্রাস মুখে পোরেন। আয়শা ভাতে ডাল মাখালেন। ডাল দিয়ে প্লেটের ভাত শেষ করেন।
মেরিনা নিজে ধীরেসুস্থে ভাত খায়। ভাত-মাংস শেষ করে। দুটুকরো ভাজা মাছও খায়। এক বাটি ডাল খায় স্যুপের মতো করে।
ওর দিকে তাকিয়ে আয়শার মনে হয়, মেয়েটি নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করেছে। ওর ভেতরে কোথাও কোনো ফাটল হয়েছে কিংবা কোথাও আগুন লেগেছে। ও নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় আছে। দুজনের কেউই ওর দিকে না তাকিয়ে ঘরের এপাশে-ওপাশে তাকান। ভাবেন, আজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঠিকমতো শুনতে হবে।
মেরিনা যখন বাবা-মায়ের মুখোমুখি বসে, তখন বেশ রাত হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটার প্রান্ত ছাড়িয়েছে। ও সরাসরি বলে, আজ আমাকে নওশীন ফোন করেছে।
নওশীন? দু
জন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
নুসরাতের ভাই। সে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মনে হলো, এখন প্রবল দাপটে আছে।
কিছু বলেছে তোকে?
হ্যাঁ। আপনারা তো জানেন, ও একটা দুষ্টু ছেলে। চান্স পেলেই নিজের বোনকে বলত, আর্মির ক্যাম্পে দিয়ে আসব।
ওর বাড়াবাড়ির কারণে ওর বাবা-মা অন্যদের নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। ও আমাকে দুটো কথা বলেছে। প্রথমে বলেছে মাজিয়ার কথা।
তোর বান্ধবী মাজিয়া?
হ্যাঁ, আম্মা। আমরা একসঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে আকাশে উড়িয়েছিলাম।
কী হয়েছে ওর?
নিউ মার্কেটের সামনে ওকে রিকশায় উঠতে দেখে নওশীন গিয়ে ওকে আটকায়। তারপর জোর করে টহলদার আর্মির গাড়িতে তুলে দেয়।
ওহ, গড!
আকমল হোসেন দুহাত চুলের মধ্যে ঢোকান। আয়শা খাতুন বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। যেন নিজের মেয়ের চেহারা মনে পড়ছে না। ওকে চেনা যাচ্ছে না।
নওশীন বিকট হাসিতে ভরে দিয়েছিল টেলিফোন। বলেছিল, পতাকা বানানোর মজা বুঝিয়ে দিলাম ওকে। বুঝুক ঠেলা। পাকিস্তানের গায়ে হাত দেওয়া সহজ কথা না।
তুই এত কথা শুনলি, মা?
অনেক ধৈর্য ধরে, কষ্ট করে শুনেছি, আম্মা। আমার পুরো বিষয়টা বোঝার দরকার ছিল। ও কত দূর এগোতে চায়, তা দেখতে চাই।
রাগারাগি করিসনি তো?
প্রথমে করিনি। কৌশল হিসেবে রাগব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরে আর ধৈর্য রাখতে পারিনি।
কী বলেছে?
একটা গুন্ডার মতো কণ্ঠস্বর বানিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছে, এইবার তুমি তৈরি হও, মেরিনা জাহান। তোমাকেও স্বাধীনতার স্বপ্ন বুঝিয়ে ছাড়ব। টের পাবে কত ধানে কত চাল।
কী বললি? আয়শা ছিটকে ওঠেন। এত বড় কথা বলেছে?
নওশীন নুসরাতের ছোট ভাই। ওদের বাড়িতে গেলে, দেখা হলে ও আমাকে আপা ডাকত। আজকে তুমি করে বলেছে, নাম ধরে বলেছে।
তুই কিছু বলেছিস?
আমিও চিৎকার করে বলেছি, তোকেও আমি দেখে নেব, শুয়োরের বাচ্চা। তারপর আমি ফোন রেখে দিয়েছি। ফোনটা পরে আবার বেজেছিল। আমি ধরিনি।
ওর কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে থাকেন আয়শা। আকমল হোসেন উঠে পায়চারি করেন।
আমি ভয় পাইনি, আম্মা। ও আমার সঙ্গে বদমাশি করতে এলে আমিও ছাড়ব না।
আয়শা খাতুন কথা না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়ের দৃষ্টি পড়তে থাকেন। মেরিনা মাকে শান্ত করার জন্য বলে, আমি বিকালবেলা নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। তিনটে ছোট-বড় ছুরি কিনে এনেছি। সব সময় আমার সঙ্গে রাখব। প্রয়োজনে সুযোগ বুঝে ব্যবহার করব। হয় পেট ফুটো হবে, নয়তো বুক।
ওর কথা শুনে আকমল হোসেন ফিরে দাঁড়ালেন।
কী বললি, মা?
আমি তো নওশীনকে ছাড়ব না, আব্বা। ওর পাকিস্তানের অখণ্ডতার স্বপ্ন আমার হাতে দুটুকরো হবে।
আমি ভাবছি, এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাব। এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না।
আয়শা চোখ গোল করে আকমল হোসেনের দিকে তাকান। সমর্থন প্রত্যাশা করেন।
আকমল হোসেন ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেন, না, সবাই ছাড়ব না। আমি একা থাকব আলতাফকে নিয়ে। তুমি আর মেরিনা যাবে।
তুমি থাকলে আমিও থাকব। আমিও বাড়ি ছাড়তে চাই না। এখনো এই বাড়িতে গোলাবারুদ-অস্ত্র আছে। এখনো এই বাড়িতে যখন-তখন ছেলেরা আসবে। খাবেদাবে, ঘুমাবে, অস্ত্র নিয়ে সরে পড়বে। মারুফ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলবে, মা, আমি এসেছি। তুমি দেখো, গেরিলারা কেউ যদি মেলাঘরে যায়, তার সঙ্গে মেরিনাকে পাঠিয়ে দাও। ওরা ওকে বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজে লাগিয়ে দেবে।
মেরিনা বাবা-মাকে সাহস দিয়ে বলে, আমি কাউকে পেলে মেলাঘরে যাওয়ার চিন্তা করব। তার আগে নওশীনকে মারব। তাহলে আমি শান্ত হব। বিশ্রামগঞ্জে হাসপাতালে আহতদের শুশ্রুষার কাজ করতে পারলে আমিও শান্তি পাব। আপনাদের এই বাড়ি ছাড়া ঠিক হবে না।
দুজনে একসঙ্গে বলেন, মেরিনা ঠিকই বলেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত এটাই হোক।
রাতে ঘুমোলেও যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট সকাল থেকে আকমল হোসেনকে ভাবিত করে। মেরিনাকে তার বোনের বাড়িতে দিয়ে আসবেন, নাকি ওর নানার বাড়িতে পাঠাবেন। বাবার প্রস্তাব শুনে মেরিনা কোথাও যেতে রাজি হয় না। ওর এক কথা, হয় মেলাঘরে যাব, নয়তো এই বাড়িতে থাকব। আমাকে ধরতে এলে একটাকে মেরে মরব। কাউকে না মেরে আমি এই দুনিয়া ছাড়ব না।