বেশ কিছুক্ষণ হলো।
আপনাদের সঙ্গে কথা আছে। আমি আসছি।
কোথায় গিয়েছিলি, মা?
আমি আসছি, আব্বা।
আকমল হোসেনের মনে হয়, ওকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।
পাশাপাশি জেদি এবং একরোখা ভঙ্গি ওর ভেতরে কাজ করছে। আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন ড্রয়িংরুমে এসে বসেন। টেলিভিশন ছাড়েন।
খবরে দেখতে পান, নতুন গভর্নর হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ডা. মালিক। তল্কালীন প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী তাকে শপথ পাঠ করান। দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ডা. মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে গেছেন গতকাল। জামায়াতে ইসলামীর এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী সর্বশক্তি দিয়ে দেশের শত্রুদের দমনের ব্যাপারে নতুন গভর্নরকে সহায়তা করবে।
আকমল হোসেন খবরের এতটুকু দেখে নিজের পড়ার টেবিলে আসেন। সকালে খবরের কাগজ পড়া হয়নি। কয়েকটি সংখ্যা টেবিলের ওপর জমা করে রেখেছেন।
পত্রিকার পাতা উল্টাতেই দেখতে পেলেন, নতুন গভর্নর ডা, মালিকের ছবি ছাপা হয়েছে। নতুন সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। তিনি পত্রিকা মুড়ে পাশে রাখলেন। খুললেন দৈনিক পাকিস্তান। একটি খবরের জন্য কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন; কিন্তু পত্রিকায় তেমন করে আসেনি। আজ সেই খবরের ওপরে চোখ আটকে গেল। লেখা হয়েছে—মরতে যখন হবেই, তখন দেশের জন্যই মরি। বিশ বছর বয়স্ক পাইলট রশিদ মিনহাজ গত ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি বিমানকে জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন।
তিনি মুখে মুখে শোনা খবরটির আরও বিস্তারিত জানার জন্য যে কাগজগুলো পড়া হয়নি, তার পাতা উল্টাতে লাগলেন। দেখলেন, কয়েক দিন ধরে কেবল রশিদ মিনহাজের বীরত্বের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। তাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করার কথা আছে। কিন্তু কে বিমান হাইজ্যাক করলেন, তাঁর নাম নেই।
শেষ পর্যন্ত নাম পাওয়া গেল। তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ কে এম মতিউর রহমান। তিনি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রশিদ মিনহাজের সাহসিকতার কারণে তিনি সে কাজটি করতে পারেননি। ভারতের সীমানায় পৌঁছানোর কয়েক মাইল আগে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। সরকার রশিদকে দিয়েছে সর্বোচ্চ বীরের খেতাব। আর মতিউরকে বলা হয়েছে বিশ্বাসঘাতক, গাদ্দার। তিনি পত্রিকা ভাঁজ করে পাশে রাখলেন। খুললেন দৈনিক পূর্বদেশ। পত্রিকায় বড় করে ছাপা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের নাম মতিউর রহমান।
আকমল হোসেন পত্রিকার পৃষ্ঠায় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। একজন বীর বাঙালিকে একটি বাংলা ভাষার দৈনিক পত্রিকা এভাবে লিখতে পারে? পরমুহূর্তে তিনি নিজের ভাবনার সংশোধন করলেন। বাংলা ভাষার অসংখ্য মানুষই তো যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হয়েছে। তাহলে শুধু একটি পত্রিকার ক্ষতের মতো শিরোনাম তাকে এমন পীড়িত করছে কেন? তিনি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। সব পত্রিকা ভাঁজ করে ফাইলে রাখেন ইতিহাস লেখার জন্য। ইতিহাসের উপকরণ রাখতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। তিনি জানেন না, ইতিহাস তিনি লিখতে পারবেন কি না, কিন্তু উপকরণ সংরক্ষণ করে যেতে তো পারবেন। যুদ্ধের পাশাপাশি এই পারাটাও নৈতিক কাজ। তিনি মতিউরকে সর্বোচ্চ বীরের খেতাব দিয়ে, বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে ডায়েরির পাতায় বড় করে লিখে রাখেন।
আয়শা এসে পাশে দাঁড়ালেন।
খাবে, চলো।
আকমল হোসেন ডায়েরি বন্ধ করলেন। কলমের মুখ আটকালেন।
ডায়েরিতে কী লিখেছ?
মতিউরের কথা। লিখেছি, বল বীর চির উন্নত মম শির। তোমার একটি গুনগুন ধ্বনি না হলে আমি আজ রাতে খেতেও পারব না, ঘুমোতেও পারব না।
চলো, একসঙ্গে গাইব।
আকমল হোসেন আয়শার ঘাড়ে হাত রাখেন। আয়শা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শুরু করেন গুনগুন ধ্বনি–
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করা দহন-দানো।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।
মেরিনা কান খাড়া করে গুনগুন ধ্বনি শোনে। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ছড়াতে থাকে সুর। আজ ওর মন ভালো নেই। প্রবল দুশ্চিন্তায় ওর প্রতিটি মুহূর্ত আক্রান্ত। তার পরও গানের শক্তিতে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আয়শার কণ্ঠ একা নয়, যুক্ত হয়েছে আকমল হোসেনের কণ্ঠও—
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোঁটাক তারা নব নব
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্বপানো।।
মেরিনা মায়ের সুরের ধ্বনি শেষ হওয়ার আগে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসে। কোথাও না রেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে ধরে রাখে।
আকমল হোসেন কাছে এসে মোমবাতি ওর হাত থেকে নিজে নিয়ে বলেন, আয় মা। তোর কথা শুনব এখন।
১৩. ডাইনিং টেবিলে বসে মেরিনা
ডাইনিং টেবিলে বসে মেরিনা প্রথমেই বলল, আমাদের পরিবারে যুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট ওপেন হয়েছে, আব্বা।
ফ্রন্ট!
শব্দটি দুজনে একসঙ্গে উচ্চারণ করেন।
হ্যাঁ, আমি বলব যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট।
দুজনে আবারও একসঙ্গে বলেন, ফ্রন্ট।
মেরিনা এক গ্রাস ভাত মুখে পুরে বলে, আপনারা ভাত খান। তার পরে শোবার ঘরে গিয়ে বলব। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি দুপুরের পর থেকে আর কোনো কিছু খাইনি।