ইনশা আল্লাহ। ছেলেরা চেঁচিয়ে বলে, স্বাধীনতার লাল সূর্য আমরা ছিনিয়ে আনব।
কাছে এসে দাঁড়ান আয়শা খাতুন আর মেরিনা।
হইচই বেশি হচ্ছে, বাবারা।
আমাদের কণ্ঠস্বর বাইরে যাবে না, খালাম্মা। পারলে তো আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতাম। এখন তো পারছি না। আপনি আমাদের কাছে বসেন, খালাম্মা।
মারুফ হাততালি দিয়ে বলে, বাবার মতো মা-ও আমাদের গেরিলাসহযোগী।
তোমরা কেউ বললে না, ভাইয়া, আমিও গেরিলা।
মিজারুল দুহাত তুলে বলে, তোমার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা তো জানি, তুমি আমাদের সঙ্গে আছ।
মেরিনা মায়ের ঘাড়ে মুখ রাখে। রান্নাঘর ছাড়া বাড়ির কোথাও আর বাতি জ্বলে না। রান্নাঘরের আলোয় ডাইনিংরুমে আলো-আঁধারি তৈরি হয়েছে, যেন আজ জ্যোৎস্না রাত। সবাই গেছে বনে। আয়শা খাতুনের বুক ধড়ফড় করে। একসময় মন্টুর মা রান্নাঘরের বাতি বন্ধ করে দেয়। টিমটিম করে মোমবাতির শিখা। তখন গুনগুন করে আয়শা খাতুন
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা…।
আস্তে আস্তে গুনগুন ধ্বনি বাড়তে থাকে। ছড়াতে থাকে ঘরে। ঘর থেকে বাইরে যায়। শহর নীরব। হঠাৎ দু-একটা আর্মির গাড়ি শাই করে চলে যায়। রাস্তায় কুকুর ডাকে না। শহরজুড়ে জেগে থাকে গেরিলাদের পায়ের শব্দ। ওরা চারদিক তোলপাড় করে আসছে। ঘিরে ধরছে শহর।
একসময় গান থামে।
আয়শা খাতুন আস্তে করে বলেন, ঘুমোত যাও, বাবারা। শরীর ঠিক রাখো। কাল তোমাদের অনেক কাজ।
ছেলেরা উঠে এসে আয়শা খাতুনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
দোয়া করবেন, খালাম্মা। এই মুহূর্তে আমাদের মা কাছে নেই। আপনি আমাদের মা।
মায়ের দোয়া ছাড়া ছেলেরা যুদ্ধে যাবে কী করে?
আয়শা খাতুন ওদের মাথায় হাত রাখেন। কারও কারও মাথার ওপর ঝরে পড়ে মায়ের চোখের পানি। সবার বুকের মধ্যে ধ্বনিত হয় একটি তারিখ। কাল ৯ জুন। ঢাকা শহরে গেরিলাদের প্রথম অপারেশন শুরু হবে। আয়শা খাতুন সবার মাথা কাছাকাছি টেনে ওদের মাথার ওপর হাত রেখে বলেন, জয় বাংলা।
ঘরের ভেতর জয় বাংলা ধ্বনি গমগম করে। সবাই মিলে বলতে থাকে। মন্টুর মা-ও সবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, জয় বাংলা।
কেউ ঘড়ি দেখেনি। রাতের কোন প্রহর সেটা, কেউ জানে না। জানতেও চায় না। সবাই জানে, এখন ঘুমাতে যেতে হবে। কেটে যাবে রাত। ওদের সবার জীবনে আরেকটি নতুন সূর্য উঠবে।
সবার আগে ঘুম ভাঙে আকমল হোসেনের। দিনের প্রথম আলো দেখা তাঁর প্রিয় অভ্যাস। আগে রমনা পার্কে হাঁটতে যেতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আর যান না। নিরাপদ বোধ করেন না একদিকে, অন্যদিকে ভাবেন, তাঁর জীবনে একাত্তর অন্য রকম সময়। এই সময়কে অন্যভাবে সাজাতে হবে। নিজের বাড়িকে দুর্গ বানাতে হবে। গেরিলাযুদ্ধ নয়তো সীমান্তের রণক্ষেত্র। একটা জায়গা তো বেছে নিতেই হবে। নিজেকে যুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে না-পারা দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করা। এমন একটি ভাবনা তিনি নিজের মধ্যে সক্রিয় রাখেন।
সকাল দশটার দিকে ওমর, কায়েস, মারুফ, স্বপন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের চারপাশ রেকি করতে যায়। আকমল হোসেন দুজনকে শাহবাগে নামিয়ে দেন। অপর তিনজনকে মিন্টো রোডের দিকে বড় নাগলিঙ্গম ফুল গাছের কাছে নামিয়ে দেন। মিজারুল তার সঙ্গে থাকে। রমনা থানার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার কোনায় তারা অপেক্ষা করবেন। বিভিন্ন সময়ে ঘোরাঘুরি করে জায়গা বদল করে আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে দাঁড়াবেন। বারোটার মধ্যে যে যার মতো ফিরে আসবে।
পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়। ছেলেরা নেমে যায়। মিজারুল পেছনের সিটে বসে আছে। আকমল হোসেন ঘাড় না ঘুরিয়ে বলেন, তোমার কী মনে হলো, মিজারুল?
সন্ধ্যায় ওদের আমরা গেটের আশপাশে নামাতে পারব, খালুজান। হোটেলের গেটের পাহারা তেমন জোরদার নয়। তেমন কোনো অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয় না।
আমিও তা-ই মনে করছি। এবার তো তোমরা শুধু আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য গ্রেনেড ছুড়বে। ওরা হকচকিয়ে যাবে। তারপর পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে তোমরা সরে পড়বে।
মিজারুল আবার বলে, খালুজান, আপনি এখন কোথাও না দাঁড়িয়ে কাকরাইল হয়ে প্রেসক্লাবের দিকে চলে যান। তারপর শাহবাগ হয়ে আমরা আবার এদিকে আসব। ততক্ষণে ওরা ফিরে আসতে পারবে। আপনি কী বলেন?
হ্যাঁ, তুমি যা বলছ তা-ই করি।
গাড়ি ঘুরে রমনা থানা পার হয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই যে যেদিকে আড়ালে ছিল সেদিক থেকে বের হয়ে গাড়িতে এসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট অন করে রাখা গাড়ি ছেড়ে দেন আকমল হোসেন। গাড়িতে ওরা হইচই করে। খানিকটুকু উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, মনে হয় না কাজটা কঠিন হবে।
আমাদের সময়ও ঠিক আছে। উপযুক্ত সময় বলতেই হবে।
মারুফ বলে, ঠিক করেছি, গেটের পাশের দেয়াল টপকে আমি হোটেলের ভেতরে ঢুকে যাব।
তোমরা এখন থামো। চুপচাপ বসে থাকো। বাড়ি গিয়ে বাকি পরিকল্পনা হবে।
ছেলেরা কথা থামায়। পরস্পরের হাত চেপে ধরে। ওদের ভেতরে প্রবল উত্তেজনা টগবগ করে। ওরা বুঝতে পারে, স্বাধীনতার পক্ষে একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষে জীবনের ঝুঁকির সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। আর সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হওয়া মানেই এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। ওদের গেরিলা অপারেশনের সবগুলো কার্যকর করা হলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কেমন করে সবাই এক হচ্ছে লক্ষ্যের দিকে। প্রবাসী সরকার বুঝবে যে ওরা পারছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঢাকা শহরকে জাগিয়ে রাখতে। আমাদের গেরিলাযোদ্ধারা-গেরিলা হো-হো-হো…। সুরের মতো বাজে শব্দের বাঁশি। আকমল হোসেন ভাবেন, আয়শা খাতুন গুনগুন করছেন। সেই গানের শব্দ এখন এই গাড়ির ভেতরে। মেরিনা গ্রেনেডগুলো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখছে। সন্ধ্যায় এগুলো নিয়ে বের হবে গেরিলারা।