আপনি এভাবে বলতে পারেন না। যিনি যোদ্ধা, তিনি বিপদের ভেতর দিয়েই হেঁটে যান। মৃত্যুভয় নিয়ে কেউ যুদ্ধে যায় না। আপনি ভাইকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। আজাদের মা যে ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন। আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী যে স্বামীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন। মিসেস ইমাম যে স্বামী ও দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন!
আয়শা কান্নাভেজা স্বরে অস্ফুট আর্তনাদ করে বললেন, উহ, থাম!
সাদেক আকমল হোসেনের দুহাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিকই বলেছেন। ওর জন্য কষ্ট হচ্ছে বলেই নিজের ওপর এমন দায় টেনেছি। দুঃখ কখনোনা খুবই ব্যক্তিগত, কখনো সামষ্টিক।
আকমল হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, আমাদের সকলের বুকবোঝাই কষ্ট আছে। আমরা কেউই কষ্ট থেকে বের হতে পারছি না। একের কষ্ট অপরের কষ্টের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অনবরত।
পাশাপাশি স্বপ্নও আছে।
হ্যাঁ, তা আছে। স্বপ্ন ছাড়া আমরা দিন গুজরান করি না।
আবার সবাই চুপ হয়ে যান। এই মুহূর্তে এসব কথার কোনো অর্থ আছে বলে মনে হয় না আয়শা খাতুনের। মনে হয়, যা কিছু বলা হচ্ছে; তা অর্থহীন। শুধু রিয়ালিটি সত্য। এই বাস্তব নিয়ে বুকে অনেক কিছু জমবে। তাকে ঘাটাঘাটি করার দরকার কী! যা জমছে জমুক। ইসমাত তাকে হাত ধরে ভেতরের ঘরে নিয়ে যায়।
মুখোমুখি চেয়ারে বসলে ভিজে ওঠে দুজনের চোখ।
ভাবি, কী হলো আমাদের?
যাত্রাপথে এমন অঘটন ঘটেই থাকে। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।
ওরা কি ফিরে আসবে?
আয়শা খাতুন চুপ করে থেকে বলেন, জানি না তো। ওদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা কি ওদের খোঁজটুকুও পাব না।
এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আমাদের চারপাশে উত্তর দেওয়ার লোক নেই।
আয়শা খাতুন জানেন, এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। উত্তর দেওয়ার সাধ্য তার নিজের নেই। শুরুর সময়ে ওরা একদিন বলেছিল, আপনার কাছ থেকে সেই গুনগুন ধ্বনি শুনতে চাই—
লাজুক হেসে থেমেছিল চুন্নু। কোন গানটা শুনতে চায়, তা বলতে দ্বিধা করছিল।
মারুফ ধমকে উঠেছিল, তুই আমার মায়ের সামনে লজ্জা পাচ্ছিস রে?
মারুফের পিঠে চাপড় দিয়ে আয়শা বলেছিলেন, আহ্, এভাবে বলিস না। তুই কোন গানটা শুনতে চাস, বল চুল্লু।
চল্ চল্ চল্ উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল…
সেদিন গুনগুন ধ্বনি শোনার পর ওরা পাঁচজন মার্চপাস্টের ভঙ্গিতে ঘরের ভেতর ঘুরেছিল। বলেছিল, আমরা পারব। যিনি এই গানের কবি, তিনি একজন সৈনিক ছিলেন। আমরাও জীবন-জয়ের সৈনিক হব।
আয়শা খাতুন ইসমাতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওরা জীবন-জয়ের সৈনিক। ওদের হাতে লাল-সূর্যের পতাকা। তাদের মাথায় তুলে রাখার সাধ্য আমাদের নাই। ভারি তো এক কাপ চা আর দুই মুঠো ভাত খাইয়েছি—
আয়শা চোখে আঁচল চাপা দেন। ইসমাত বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকে। মধ্যরাতে হিংস্র সেনাদের হাতে ধরা পড়া কতিপয় যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় ওদের বাকি জীবনের সঞ্চয়। এই সঞ্চয় ইতিহাসের। স্বাধীনতার গৌরবের। যদি বেঁচে থাকেন, তারা এই সঞ্চয়ের সাক্ষী হবেন। আয়শা ইসমাতকে জড়িয়ে ধরলে দুজনের নিঃশ্বাস দুজনের শরীরে বয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের স্পর্শ অনুভব করেন। এবং দুজনেই বলেন, আমরা রাত জেগে ওদের জন্য অপেক্ষা করব। পাকিস্তানি সৈন্যদের শত নির্যাতন আমাদের পিছিয়ে রাখতে পারবে না। বাড়ি আক্রান্ত হলেও আমরা ভীত নই।
আয়শা ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা ওদের জন্য জেগে থাকব। আমাদের কেউ মেরে শেষ করতে পারবে না।
ওরা যতই খুঁজে খুঁজে আমাদের দুর্গগুলো ভেঙে চুরমার করুক, আমরা নতুন দুর্গ গড়ব।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আবার শহরকে কাঁপাবে।
কথা বলতে বলতে নেমে যান আয়শা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকমল হোসেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও কেউ কেউ। আয়শা বাড়িটা দেখেন। একতলা বাড়িটার সামনে যোদ্ধারা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত। দুর্গবাড়িটির একটি স্বাভাবিক ইমেজ রাখার জন্য। আয়শা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আকমল হোসেনের দিকে তাকান।
চলো।
আপনারাও সাবধানে থাকবেন।
সাবধান! আকমল হোসেন সবার দিকে তাকান।
আমরা একটা ধাক্কা খেলাম না।
আমরা যা করছি তার থেকে তো পিছিয়ে যেতে পারব না। সাবধান শব্দটি আমরা সঙ্গেই রাখি। তার পরও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
আপনারা না থাকলে ওরা সাপোর্ট পাবে কোথায়? অপারেশন চালানোর জন্য ওদের আশ্রয় দরকার। খোলা মাঠ থেকে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালিত হয় না।
আমরা আপনার কথা বুঝেছি। আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরা যাই।
গাড়ি ছুটছে।
ছুটছে ঘরবাড়ি। মানুষ। গাছপালা।
ছুটছে চিন্তা এবং পরিকল্পনা।
আয়শা বলেন, আমরা বাড়ি যাচ্ছি।
আমরা তো বাড়িতেই ছিলাম। এতক্ষণ আমরা যা দেখেছি, তার খতিয়ান করেছি।
আমরা কি বাড়িতে আছি?
এখনো আছি।
এবং থাকব।
ওরা যদি এই বাড়ি আক্রমণ করতে আসে?
আসবে।
ওরা যদি উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায়?
যেতে হলে যাব।
আমি খুশিমনে যাব।
যদি বন্দিশালায় ওদের দেখা পাই, মনে করব, ঠিক জায়গায় এসেছি। যদি ওদের সঙ্গে কথা হয়, বুঝব, ভুল ঠিকানায় যাইনি। যদি ওদের সঙ্গে মৃত্যু হয়, মনে করব, স্বাধীনতা পেয়েছি।
বিষাদ এবং কষ্ট নিয়ে দুজনে শোবার ঘর ছাড়েন। কতক্ষণ আগে বাড়িতে ফিরেছেন, তা ভুলে যান। দুপুরের ভাত খাওয়া হয়নি, তা মনে থাকে না। ঘুম কী জিনিস, তা-ও ভুলে যান। রেস্ট শব্দটি তাদের জীবনপাতার কোথাও লেখা নেই। দুজনে মৃদু পায়ে বারান্দায় আসেন। দেখতে পান, আলতাফ গেট খুলে দিচ্ছে। মেরিনা রিকশা থেকে নামছে। ও বারান্দায় বাবা-মাকে দেখে বলে, আপনারা কখন ফিরলেন?