আকমল হোসেন তাঁর দিকে তাকালে তিনি বলেন, ধানমন্ডি আটাশে চলো যাই।
আকমল হোসেন পা বাড়াতেই একজন বলে, ওই বাড়ি থেকে কেউ ধরা পড়েনি। গেরিলারা কেউ ছিল না। আমি বাড়িতে ঢুকেছিল। এই ঘটনার দুদিন আগে দুজন যোদ্ধা মেলাঘরে চলে গিয়েছিল। ওরা একজন দারোয়ানকে ধরে। অন্যজন পালিয়ে যায়।
চলো, আমরা দিলু রোডে যাই।
হ্যাঁ, চলো।
গলি ছেড়ে বের হয়ে গাড়ি মেইন রোডে ওঠে।
ছুটতে শুরু করে গাড়ি। পৌঁছে যায় দিলু রোডে। মেইন রোড থেকে বেশ অনেকটা ভেতরে ছিল বাড়িটা। আকমল হোসেন যখনই এসেছেন, মাঠে এক চক্কর ঘুরেছেন। বাড়ির পাশের বড় মাঠটি তিনি খুব পছন্দ করেন। আলমকে বলেন, মাঠটি হলো শান্তির জায়গা। আলো-বাতাসের মুক্তি। পতাকা ওড়ানোর মুক্তি।
হা হা করে হাসত আলম। বলত, তোমার ভাবনাই অন্য রকম। কোথাকার জিনিস কোথায় যে নিতে পারো। ভাবতেও পারো, বাপু।
আলমের হাসি বুকে নিলে যুদ্ধের ছবি অন্য রকম হয়ে যায়। যুদ্ধ আর প্রতিদিন এক হয়ে থাকে।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
একজন বলল, বিশ-পঁচিশ জন সেনা এসেছিল। প্রবল মারমুখী হয়ে। সে রাতে বাড়িতে এসেছিলেন কাজী। আজাদের বাড়িতে আর্মি ঢুকলে কাজী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্যাপ্টেনের ওপর। বেশ ধস্তাধস্তি হয়েছিল। সেপাইরা এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয় দুজন যোদ্ধা। আহতদের ফেলে রেখে অন্যদের ধরে নিয়ে যায় সৈন্যরা। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়া কাজী এই বাড়িতে এসেছিল।
আকমল হোসেন দাঁড়িয়ে রইলেন।
আয়শা ভেতরে ঢুকেছেন। যোদ্ধারা কেউ নেই বাড়িতে। বাড়ির মেয়েরাও সবাই নেই। শুধু একজন আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে সে করাচি থেকে এসেছে। এই বাড়ির বড় মেয়ে সে।
সে বলল, বাবা আর্মির উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনের দেয়াল টপকে পাশের বাসায় চলে গিয়েছিলেন।
আয়শা জানেন, এ বাড়ির ছেলে একদম প্রথম দিককার গেরিলাযোদ্ধা। নিজের বিছানায় কোলবালিশ চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিল যুদ্ধে। তবে বাবার কাছে একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল।
আয়শা তার বোনের দিকে তাকালে সে বলে, আমি খুব ভালো উর্দু জানি। ওদেরকে করাচি থেকে এসেছি, সে কথা বললাম। বিমানের টিকিট দেখালাম। কিছুটা দমল ওরা। কিন্তু ওদের আক্রমণটা এল অন্য দিক থেকে। মনে হলো, ওরা যেন জেনেশুনেই এসেছে যে বাড়ির কোথায় কী আছে। ওদের হাঁটাচলার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হয়েছিল, বাড়ির ম্যাপটা ওদের মুখস্থ। দেড় তলা বাড়িটা ওদের নখদর্পণে। ওরা সরাসরি রান্নাঘরে যায়। রান্নাঘরে ওদের কী আছে, তা ওরা যেন জেনেশুনেই এসেছে। সেপাইরা আগেই শাবল এনে রেখেছিল। ওরা রেডি ছিল। ক্যাপ্টেনের ইশারা পেয়েই শাবল দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে খুঁড়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ বের করল। ক্যাপ্টেনসহ অন্যরা হা হা করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, বহুত আচ্ছা। বহুত আচ্ছা।
আরও কী কী সব বলেছিল, তা আমি মনে করতে পারছি না। আমার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা ছিল, ওরা রান্নাঘরে অস্ত্রের খোঁজ পেল কোথা থেকে! আমার আব্বা মেঝে খুঁড়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ রেখেছিলেন। তার ওপরে স্ল্যাব দিলেন। স্ল্যাবের ওপর রাখা হলো কেরোসিনের চুলা। পাশে শুকনো লাকড়ি। বোঝার কোনো উপায় ছিল না। অথচ ওরা ঠিকই শাবল দিয়ে মেঝে খুঁড়ে ফেলল।
যোদ্ধার বোন দুহাতে মুখ ঢাকলে আয়শা তার মাথায় হাত রাখেন। গুনগুনিয়ে বলেন, আমার সকল দুঃখের প্রদীপ…। মেয়েটি তার দুহাত জড়িয়ে ধরে। আয়শার সামনে দেড় তলা বাড়িটি যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। যে বাড়িতে অস্ত্র রাখা হয়, যোদ্ধারা থাকে, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করতে আসা সে বাড়ি তো একটি যুদ্ধক্ষেত্রই হবে। এমন দুর্গবাড়িগুলো এখন এই শহরের প্রাণ।
ওদের গাড়ি আবার ছুটছে। যাচ্ছে নাসিরাবাদ। এখানকার বাড়িটিও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের ও অস্ত্র রাখার জায়গা। দূর থেকেই দেখলেন, বাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাই ও কয়লার স্কুপের পাশে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত লাশ। চিত হয়ে পড়ে থাকা লাশে অজস্র বুলেটের চিহ্ন।
তাঁরা গাড়ি থেকে নামলেন না। গেলেন এলিফ্যান্ট রোডে। একটি সরকারি বাড়ি এটি। বড় ভাই সরকারি চাকুরে। ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা। এ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। যখন-তখন যেকোনো প্রয়োজনে চলে আসত ওরা। এমন অনায়াস যাতায়াতের জন্য ভীত ছিলেন গৃহকর্তা। তিনি সরকারি বাড়িতে বসবাস করতেন চাকরিসূত্রে। অন্যদিকে বাড়িতে অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল। আলমারিতে স্যুটের আড়ালে রাইফেল লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। গ্রেনেড ছিল অনেকগুলো। চুল্লু বুঝতে পেরেছিল যে একটা কিছু ঘটবে। প্ল্যান ছিল সকালের আগেই এসব অস্ত্রসহ সরে পড়বে। কিন্তু হয়নি। ভোর হওয়ার আগেই আর্মির গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামে। দরজায় বুটের লাথি পড়লে ঘুম ভেঙে যায় সাদেকের।
বাড়িতে অতিথি এলে এভাবে দরজায় ধাক্কা দেয় না। এত রাতে কারও আসার কথাও নয়। তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া আর্মির নজরদারিতে পড়েছে? শুনতে পায়, দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে বলে গালাগালি করছে সেপাইরা।
সাদেকের মুখের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন বলতে চান, এখন মধ্যরাতে সেপাইরা নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের জীবন। লাথি দিয়ে, তো দিয়ে, বুলেটের আঘাতে, বেয়নেটের খোঁচায় তারা যা খুশি তা করতে পারে।
সাদেক বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, এই বাড়িতে আমি ওকে প্রশ্রয় না দিলে ওকে হয়তো আর্মির হাতে ধরা পড়তে হতো না। অন্তত আমার সামনে থেকে ওকে ধরে নিয়ে যেতে দেখতাম না।