গাড়ি লক করে আকমল হোসেন বললেন, এসো।
নিস্তব্ধ এলাকা। তিন মাস আগে রেললাইনের কাছাকাছি জায়গায় নামিয়েছিলেন মাহমুদাকে। এখন যাবেন রেললাইন থেকে শিল্প এলাকার দিকে খানিকটুকু এগিয়ে হাতের ডান দিকের একটি গলিতে। একতলা বাড়ি। দেখলেন আশপাশের বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ। এই একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন, সামনের দরজা খোলা। দু-চারজন মানুষ চুপচাপ বসে আছেন। বাড়িতে পরিচিত কেউ আছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না।
একজন বললেন, আসুন। বসুন। আপনাকে আমি চিনি। ভাগনের মুখে আপনার কথা শুনেছি। আপনার ছেলে কোথায়?
আয়শা বুঝলেন, তার ছেলে রাতে এই হাইডে ছিল না। আকমল হোসেনও উত্তর পেয়ে গেছেন। তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন, মারুফ যে কোথায়, তা তো আমি জানি না।
জানারই কথা। এ কয় দিনে ঢাকায় না থাকলে হয়তো রূপগঞ্জে আছে, নয়তো মেলাঘরে।
হ্যাঁ, সেরকমই হবে।
কাল এ বাড়িতে গোলাগুলি হয়েছে। কাজী গুলি করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যকে। তারপর পালিয়ে যেতে পেরেছে। ধরা পড়েছে বাকি ছয়জন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন রেকি করতে গিয়ে জুয়েলের আঙুলে গুলি লেগেছিল। ও দিলু রোডের বাড়িতে ছিল।
আকমল হোসেন ভুরু কুঁচকে বলেন, আমি শুনেছিলাম, ও অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মাকে ওর দেখতে যাওয়া হয়নি। মানে, ও যায়নি। ও এসেছিল এই বাড়িতে। ওদের পরিকল্পনা ছিল অপারেশনের। আজাদের সঙ্গে ও ধরা পড়েছে।
আকমল হোসেন বিবর্ণ মুখে কথাগুলো শোনেন। মনে মনে উচ্চারণ করেন, সেই ছেলেটি…। আয়শা খাতুন ভেজা চোখ নিয়ে অন্যদিকে তাকান। একদিন ও বলেছিল, আমি গাজরের হালুয়া পছন্দ করি। আমি আরও এক বাটি হালুয়া খাব।
আয়শা বিব্রতবোধ করে চুপ করে ছিলেন। সেদিন বাটিতে আর হালুয়া ছিল না।
ও মৃদু হেসে বলেছিল, জয় বাংলা মামণি, যেভাবে বসে আছেন, আমার মায়ের হাতেও খাবার না থাকলে এমন গোমড়া মুখে বসে থাকতেন। দিতে না পারার কষ্ট আমি মায়েদের মুখ দেখে বুঝতে শিখেছি।
আয়শা খুঁজে দেখার দৃষ্টিতে বাড়িটি দেখেন। গলির রাস্তাটির এমাথাওমাথায় তাকান। রিকশাগুলো খোঁজেন। ভাবেন, যদি কোনো পরিচিত মুখ দেখতে পাওয়া যায়। যদি কেউ কাছে দাঁড়িয়ে বলে, জয় বাংলা মামণি, ঠান্ডা পানি চাই। ফ্রিজে কি পুডিং আছে? আজ কি মুগের ডাল রান্না হয়েছে? পুঁইশাক-চিংড়ি মাছের তরকারি? আমি বিরিয়ানি খাব। কাচ্চি বিরিয়ানি।
আয়শা নিজের ভেতর আচ্ছন্ন হয়ে যান। তার চোখের সামনে থেকে একতলা বাড়িটি উধাও হয়ে যায়। জেগে থাকে অপার প্রান্তর। যেখানে শত শত ছেলেমেয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিন একজন এক বস্তা গুলি এনে বলছে, এগুলো রাখেন। দরকারমতো নিতে থাকব। তিনি তো রেখেছেন। গ্যারেজের মেঝে খুঁড়ে। সেদিন সব ব্যবস্থা শেষ করতে রাত ফুরিয়ে গিয়েছিল। একবারও মনে হয়নি, আজ না কাল করব। এখন না তখন। ছেলেদের যা হুকুম, সেটা তো নিমেষে করতেই হয়।
আকমল হোসেন বলেন, চলো, যাই।
আয়শা খাতুন বিড়বিড় করে বলেন, বিদায়, যোদ্ধারা। তোমরা ধরা পড়েছ। যদি ছাড়া পাও, আবার দেখা হবে।
আকমল হোসেন আবার বলেন, চলো যাই। যুদ্ধক্ষেত্র দেখার শেষ থাকে, আয়শা। যত দিন বাঁচব, এই সব যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে হবে। স্মরণের দীপশিখায় আমাদের জ্ঞানের আলোয় দেখতে হবে। ইতিহাসের পাতায় গেঁথে রাখতে হবে পরবর্তী মানুষদের জন্য।
গাড়ি আবার ছুটছে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
এলিফ্যান্ট রোডে।
কণিকা বাড়িতে?
হ্যাঁ। মাত্র কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম ওখান থেকে।
যুদ্ধের সময় মুহূর্তে মুহূর্তে অন্য রকম হয়ে যায় সবকিছু। আনন্দ-কষ্ট পাশাপাশি থাকে।
জানি। বুঝতে পারি। আমরা প্রতি মুহূর্তে এর ভেতরে দিন কাটাচ্ছি।
গাড়ি যাচ্ছে। দুজন চুপ। তারা বুঝতে পারেন, আজ তাদের কথা বুকের ভেতরে বেশি। যেটুকু বলছেন, সেটুকু জোর করে। অনেক বেশি কথা ভেতরে স্তব্ধ হয়ে আছে।
গাড়ি গেটের কাছে থামলে তারা দেখলেন, দু-তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলল, খালাম্মা বাড়িতে নাই।
একজন বলল, পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গেছে। রুমীর বাবাকেও।
আয়শা স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ইমাম ভাইকেও?
কেউ কোনো উত্তর দিল না। আকমল হোসেনের মনে হলো, তিনি একজন অসহায় মানুষ। যুদ্ধের সময় মানুষ কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির শিকার হয়। মানুষের অসহায়ত্ব নির্ণয় করা কঠিন।
কেউ একজন বললেন, সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত মোট ছয়টি বাড়ি আক্রমণ করেছে সৈন্যরা। প্রথম আক্রমণ হয়েছে মগবাজারের ৪১৫ নম্বর বাড়ি। ধরে নিয়ে গেছে আবদুস সামাদকে।
আমরা তো ওই দিক থেকেই এলাম। জানতাম না বলে ঢোকা হয়নি। এমন সর্বনাশ কী করে হলো? ওরা কেমন করে জানল?
কেউ কোনো কথা বলে না। কোন অন্তরালে কোথায় কী ঘটেছে, তা তো কেউ জানে না। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো কাঁদতে শুরু করে।
আরেকজন বলে, ওই বাড়ির পেছন থেকে ধরা পড়েছেন সরকার আবদুল হাফিজ। নির্যাতনে তার একটি চোখ বের হয়ে গিয়েছিল। একটি রগের সঙ্গে তাঁর চোখটি আটকেছিল।
উহ, মা! আয়শা খাতুন অস্ফুট শব্দ করেন। তিনি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখছিলেন অন্য বাড়িগুলো। মেইন রোড থেকে যে গলিতে বাড়িটা, সেটা একটা ব্লাইন্ড গলি। কণিকা বাড়ির পরে আর একটি মাত্র বাড়ি আছে। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ারও রাস্তা নেই। সব বাড়িতে অজস্র গাছ। বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতা চকচক করছে। ফুল আছে অনেক গাছে। গেরিলাযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং গোলাবারুদের আনা-নেওয়ার মধ্যে আশ্চর্য স্নিগ্ধ প্রকৃতি। আয়শা খাতুনের মনে হয়, সংগীতের মতো এই প্রকৃতি, যা মানুষের চিত্তকে মোহিত করে। শান্তির মগ্নতায় মানুষ স্থির হয়। আজকের প্রকৃতি ধরা পড়া গেরিলাদের জন্য প্রার্থনা করছে। আয়শা খাতুন এতক্ষণে বুকের ভেতর স্বস্তি অনুভব করেন।