স্বাধীনতাযুদ্ধের কঠিন সময়ে দিনরাতের কোনো আলাদা প্রহর হয় না। এর রং দুটি—হয় কালো, না হয় সাদা। হয় আনন্দ, না হয় কষ্ট হয় জীবন, না হয় মৃত্যু। এমন ভেবে ডায়েরির পাতা ভরালেন তিনি। সময়ের স্মৃতিচারণা করলেন। গতকাল মেলাঘর থেকে তিনজন গেরিলাযোদ্ধা ঢাকায় ঢুকেছে। তাদের কথা লিখলেন। ওরা বলেছে, একটি সিটি টেরোরাইজিং অপারেশন করতে হবে। প্রতি মুহূর্তে শত্রুপক্ষকে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া গেরিলাযুদ্ধের কৌশল।
ওদের দীপ্ত চেহারায় যুদ্ধ ও শান্তির ছবি প্রতিফলিত হচ্ছিল। ওদের স্নিগ্ধতার সঙ্গে বারুদের গন্ধের মাখামাখি ছিল। তিনি আঁকিবুকি রেখায় ওদের নাম লিখলেন। ডিজাইন করলেন নামের রেখার সঙ্গে ফুলপাতা এঁকে। মনে হলো, এইটুকুতে তার খানিকটুকু স্বস্তি ফিরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে নামের সঙ্গে পতাকার ছবি আঁকলেন। ডায়েরির বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা এভাবে ভরালেন। মনে করলেন, এটিও যুদ্ধের স্মৃতি।
রাত বাড়ছে।
তিনি ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু ঘুমোবার কথা তার মনে এল না। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে রাখলেন। আয়শা ঘুমোচ্ছ। ভাবলেন, ও ঘুমাক। এই মুহূর্তে ঘুমই ওর যুদ্ধ।
এই রাতে ঢাকা শহরের গেরিলাদের আশ্রয়-বাড়ি আক্রমণ করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আক্রমণের সময় ছিল সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত। বেশ অনেকজন গেরিলা ধরা পড়েছে। এই খবরে মর্মাহত আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।
সারা দিন গাড়ি চালিয়ে প্রতিটি আক্রান্ত বাড়িতে গেরিলাদের খবরাখবর নিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলেন দুজন।
মেরিনার খোঁজ করলেন। বাড়িতে নেই ও। কোথায় গিয়েছে, তা কাউকে বলে যায়নি। আয়শা খাতুন শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। আকমল হোসেন নিজের পড়ার টেবিলের ওপর কনুই রেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন।
গতকাল রাব্বি, বাকের আর শরীফ অস্ত্রসহ ঢাকায় ঢুকেছিল। অপারেশনের নতুন পরিকল্পনা ছিল ওদের। দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সেই ট্রাঙ্ক বাড়ির পেছন দিকে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
ওই বাড়ির কারও কাছ থেকে এসব কথা শুনেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছিল পাকিস্তানি কয়েকজন সেনা, পেছন দিকের গেটের দরজা ভেঙে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেছিলেন, আমাদের যোদ্ধা মানুষটি সৈনিকদের জিজ্ঞাসার সামনে নির্ভীক ছিলেন। নিজে একাই কথা বলেছিলেন। কাউকে কোনো কথা বলতে দেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নিয়েই তিনি বন্দী হয়েছিলেন।
আকমল হোসেন চারদিকে তাকিয়ে বাড়িটি দেখছিলেন। আয়শা ছিলেন তাঁর পাশে। দেখেছিলেন খোঁড়া মাটির স্তুপ। জানতেন, ঘরের কোথাও তার প্রিয় হারমোনিয়াম আছে। এই হারমোনিয়ামে তিনি অসাধারণ সুর তুলেছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে। এই বছরেও সেই গান গেয়ে শহীদ মিনারে গিয়েছিল শহরের মানুষ।
সুরের মানুষের দাঁত ভেঙে যায় রাইফেলের বাঁটের প্রচণ্ড আঘাতে।
বেয়নেটের খোঁচায় কপালের চামড়া উঠে যায়। চামড়ার একাংশ ঝুলতে থাকে কানের পাশে।
সেই অবস্থায় সুরের মানুষ মাটি খুঁড়তে থাকেন। টেনে তোলেন লুকিয়ে রাখা অস্ত্র। তুলে দেন শত্রুর হাতে। যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই, তাদের হাতে। তিনি তখন জানতেন না স্বাধীনতা দোরগোড়ায়। মাত্র সাড়ে তিন মাস বাকি।
একজন বললেন, তিনি সুর আর অস্ত্রের সঙ্গে জীবন বাজি রেখেছিলেন।
আকমল হোসেন শুনতে পেলেন কান্নার শব্দ।
শুনতে পেলেন শিশুর চিৎকার।
তিনি জানতেন, তাঁর মেয়েটির নাম শাওন। বয়স চার বছর মাত্র।
তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যখন বন্দী করে গাড়িতে তোলা হলো, তিনি বুঝলেন, অতি যত্নে সংরক্ষিত অস্ত্র আর গেরিলাযুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। এই ভাবনায় তার ভেতরে যন্ত্রণা দগ্ধীভূত হলো।
আকমল হোসেন দেখলেন, বাড়ির ছাদে রোদ লুটোচ্ছে। উঠোনের কাঁঠালগাছে কাকেঁদের কা কা শব্দ নিস্তব্ধতার বুক চিরে দিচ্ছে।
বাড়িটির খুব কাছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পঁচিশের রাতে পুলিশ লাইনে ভয়াবহ তাণ্ডব সংঘটিত হয়েছে। এখন পুলিশ লাইনের ব্যারাকে বন্দী আছে মেয়েরা। নির্যাতনে জর্জরিত মেয়েদের কণ্ঠে আছে প্রতিশোধের শপথ। তিনি দূরের দিকে তাকিয়ে রাবেয়ার কথা ভাবলেন। সুইপার রাবেয়া। সুইপার পরদেশীর কথাও ভাবলেন। তাঁর মনে হলো, যুদ্ধক্ষেত্রের পুরোটাই এখন তার সামনে।
তিনি আয়শা খাতুনকে নিয়ে মগবাজারে এলেন। এই প্রথম তিনি গাড়ি চালাতে ক্লান্তি বোধ করলেন। তাঁর মনে হচ্ছে, পথ ফুরোচ্ছে না। সামনে আরও দীর্ঘ পথ। যেতে হবে, যেতেই হতে থাকবে।
মগবাজারের ৩০ নম্বর দুর্গবাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামতে নামতে মনে হয়, এই বাড়ি থেকে যদি মারুফ গ্রেপ্তার হয়ে থাকে, তাহলে কোথায় খুঁজবেন ওকে? না, তিনি ওকে খুঁজতে নামেননি। ক্র্যাক প্লাটুনের সব সদস্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন, যারা তাঁর বাড়িতে সব সময় যোগাযোগ রেখেছে। কখনো থেকেছে, কখনো থাকেনি। কখনো তার বাড়ি থেকে অস্ত্র নিয়ে অপারেশনে বেরিয়ে গেছে।
হঠাৎ করে আয়শা খাতুন তার দিকে তাকিয়ে বলেন, মারুফ!
আমাদের একটিমাত্র ছেলেই গেরিলাযোদ্ধা নয়, আয়শা।
তা নয়। ওর সঙ্গে সব নামই থাকে। কখনো একটা নামই উচ্চারিত হয় নিজের অজান্তে। পেটে ধরেছি। লালন-পালন করেছি। এইটুকু মায়া ও আমার কাছ থেকে বেশিই পাবে।
আয়শা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁর মনে হচ্ছে, আজ তিনি একটু বেশি ঘামছেন। বারবার মুছেও ঘাম কমাতে পারছেন না। কেমন করে যাবেন মুক্তিযোদ্ধা রাশেদের মায়ের সামনে? কেমন করে জিজ্ঞেস করবেন, যারা ধরা পড়েছে তাদের নাম কী? জিজ্ঞেস না করেও রাজারবাগ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে জানতে পেরেছিলেন সুরের মানুষটির সঙ্গে আর কারা ধরা পড়েছিল। এখন কী করবেন? বুকের ভেতরে প্রবল আতঙ্ক!