সবার কথা শুনে আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন বিষণ্ণ হয়ে যান। বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকেন। দেখতে পান, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য। চারদিকে ম্রিয়মাণ দিন। প্রবল বিষণ্ণতায় আক্রান্ত দুজন মানুষ তো এই সময়কে দেখছেন একটি বড় ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। সেই ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারা তাদের প্রত্যেকের কাছেই গৌরবের অংশীদারি হওয়া। তবে তারা কেন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবেন?
দুজনে একই ভাবনায় আত্মস্থ হওয়ায় ফাঁকে মেরিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি নিজের ঘরে গেলাম, আম্মা। আমি নাশতা খাব না। আমাকে ডাকবেন না।
তুমিও রান্নাঘরে ঢুকবে না, মন্টুর মা?
আমি তো ঢুকবই। আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের দেখে শরীর আর তেমন খারাপ লাগছে না। আমি ঠিক হয়ে গেছি।
মন্টুর মা শাড়ির আঁচল নিজের মাথার ওপর তুলে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। আলতাফ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলে, আজ বোধ হয় বাজার লাগবে না। কালকে তো অনেক বাজার করেছি।
তোমার কি বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে না?
করছে। বাজার করতে আমার ভালো লাগে। আপনি বললে আমি এখনই যাব।
তুমি তো জানো, আমার ছেলেটা যখন-তখন আসতে পারে। ওর জন্য…
ও একা নয়, খালাম্মা। আমাদের এখানে গেরিলাযোদ্ধা যে যখন আসবে, তাদের জন্য আমাদের কিছু-না-কিছু খাবার মজুত রাখতেই হবে। আমি কি বাজারে যাব?
আমি দেখে নিই ফ্রিজে কী আছে। তারপর ঠিক করব বাজার লাগবে কি। তুমি তো সকালে কিছু খাওনি, আলতাফ?
এখনো কিছু খাইনি। খাব। আমি তো পান্তা ভাত খেতে চাই।
আয়শা হাসতে হাসতে বলেন, সঙ্গে পোড়া মরিচ আর পেঁয়াজ। এবং ভাতের সঙ্গে থালাভর্তি পানিও চাই।
আলতাফ আর কথা বাড়ায় না। হকার খবরের কাগজ নিয়ে আসে। আলতাফ গেটের কাছে গিয়ে কাগজ নেয়। আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে রাখেন কাগজের জন্য।
পত্রিকায় অস্ত্রের ছবির ওপর সহজে দৃষ্টি আটকে যায়। প্রথমে ক্যাপশন পড়েন : শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার : কয়েকজন গ্রেপ্তার।
তিনি কাগজ মুড়ে ফেলেন। চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। কীভাবে কী হলো? কোথায়? কাদের ধরল সেনা অফিসাররা?
ফোন করলেন আশরাফকে।
আশরাফ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। বেশ কয়েকটি বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। ধরা পড়েছে কয়েকজন গেরিলাযোদ্ধা।
আবার কান্নার শব্দ ভেসে এলে মর্মাহত আকমল হোেসন বলেন, বুঝেছি। আমি পরে শুনব। এখন থাক।
আকমল হোসেন নিজেকে সামলান। বুকের ভেতরে প্রবল তোলপাড়। হাত থেকে রিসিভার পড়ে যায়।
আয়শা রিসিভার ওঠাতে ওঠাতে বলেন, কী হয়েছে?
আকমল হোসেন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নেন। তার পরও তিনি একজন পর্যদস্ত মানুষ। গলা দিয়ে স্বর বের হতে চায় না। দুবার কাশেন।
আয়শা খাতুন তাঁর হাত ধরে বলেন, এসো, বসবে।
দুজনে সোফায় গিয়ে বসেন।
যুদ্ধ তো একতরফা হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে নানা বিপর্যয় আছে। আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। আমাদেরকে এই সহজ কথাটা বুঝতে হবে।
আয়শা প্রথমে চমকে ওঠেন। তারপর নিজেকে নিজে সামলে বলেন, গেরিলাদের কিছু হয়েছে?
হ্যাঁ।
ধরে পড়েছে?
বেশ কয়েকজন।
শহীদ?
এত খবর একবারে নিতে চাইনি। আশরাফ কাঁদছিল। আমি নিজে বের হব। বিভিন্ন বাড়িতে যাব।
আমিও যাব।
হ্যাঁ, যাবে।
নীরব হয়ে যায় বাড়ি।
আয়শার গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে–
অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে।।
যে ফুল গেছে সকলে ফেলে
গন্ধ তাহার কোথায় পেলে।
গুনগুন ধ্বনি শুনে মেরিনা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। কী ঘটল? মায়ের কণ্ঠে শুনগুন ধ্বনি কেন? ও দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভেতর ঢোকে না। আয়শা খাতুনের কণ্ঠে সুর জেগে ওঠে—
যার আশা আজ শূন্য হলো কী সুর জাগাও তাহার আশে॥
সকল গৃহ হারাল যার তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাসা॥
আকমল বারান্দায় উঠে আসেন। তিনি বুঝে গেছেন গুনগুন ধ্বনির অর্থ কী। কোথায় কী ঘটল? তার পা কাঁপে। তার চোখ ভিজে আসে।
রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে মন্টুর মা। কোথায় কী হলো? কেন গুনগুন ধ্বনি ছড়িয়ে গেছে বাড়িতে? কেন এই ধ্বনি বুকে এসে বাধে? কেন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে? মন্টুর মা দরজায় মাথা রেখে নিজেকে সামলায়। সুর ছড়াতে থাকে–
শুকালো যেই নয়নবারি
তোমার সুরে কাঁদন তারি।৷
ভোলা দিনের বাহন তুমি
স্বপন ভাসাও দূর আকাশে।।
গুনগুন ধ্বনি শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেরিনা সেই সুর বুকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়। মন্টুর মা রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভ থেকে চায়ের কেটলি নামায়। আলতাফ বারান্দায় বসে খবরের কাগজ খোলে আর ভাঁজ করে।
গান শেষ হয়ে গেছে। জেগে থাকে রেশ।
অকস্মাৎ আকমল হোসেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ফোপাতে থাকেন। যেন সারা জীবনের কান্নার সঞ্চয় আজ এক লহমায় শেষ করবেন। শেষ না করে তার উপায় নেই। কারণ রোধ করার সাধ্যও নিঃশেষ।
একসময় আয়শাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। জীবনের শেষ রক্ত দিয়ে প্রভাতের আলো দেখতে চাই।
১২. অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলেন
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলেন আকমল হোসেন।
টেবিলের ওপর ডায়েরি খোলা। কখনো লিখছেন, কখনো চুপচাপ বসে থাকছেন। বুঝতে পারছেন, নিজের চিন্তাশক্তি বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বারবার বোঝালেন যে, যুদ্ধ কোনো সুখের সময় নয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।